সেদিন আমি ঘরের কিছু কাজ করছিলাম, এ সময় আমি আমার সবচেয়ে ছোট ছেলেকে তার বাবার আইপ্যাড দিয়েছিলাম তাকে কিছু সময় ব্যস্ত রাখতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমার হঠাৎ খুব অস্বস্তি লাগলো। আমি ঠিকভাবে খেয়াল করছিলাম না, সে কতক্ষণ ধরে আইপ্যাড ব্যবহার করছে বা সে সেখানে কী দেখছে। তাই আমি তাকে বললাম, এখন থামার সময় হয়েছে। তারপর দেখলাম সে ভীষণ রেগে গেলো। সে লাথি মারলো আর চিৎকার করতে শুরু করলো। সে আইপ্যাডটা আঁকড়ে ধরে ছিলো এবং রেগে থাকা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর শক্তি দিয়ে আমাকে সে ঠেলে দূরে সরাতে চাইলো। স্বীকার করছি, একজন অভিভাবক হিসেবে এটা আমার সবচেয়ে ভালো মুহূর্ত ছিল না, আর তার এমন অতিরিক্ত রেগে যাওয়া আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়।
আমার বড় সন্তানরা সোশ্যাল মিডিয়া, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং অনলাইন গেমিং-এ সময় কাটাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে এটাও আমাকে চিন্তায় ফেলে দেয়। আমি শুনি তারা একে অপরকে ঠাট্টা করে বলে ঘাস ছুঁতে হবে মানে হলো প্রযুক্তি থেকে একটু দূরে গিয়ে বাইরে সময় কাটাতে হবে। প্রয়াত স্টিভ জবস, যিনি অ্যাপলের সিইও ছিলেন। তার কোম্পানি যখন আইপ্যাড বাজারে ছাড়ে, তিনি নিজের সন্তানদের এই ডিভাইস ব্যবহার করতে দেননি। বিল গেটসও বলেছেন যে, তিনিও নিজের সন্তানদের প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন।
স্ক্রিন টাইম এখন খারাপ খবরের প্রতীক হয়ে গেছে, তরুণদের মধ্যে হতাশা, আচরণগত সমস্যা এবং ঘুমের অভাবের জন্য একে দায়ী করা হয়। বিশ্বখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী ব্যারোনেস সুসান গ্রিনফিল্ডের মতে, ইন্টারনেটের ব্যবহার এবং কম্পিউটার গেম কিশোরদের মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে। তিনি ২০১৩ সালে দীর্ঘ সময় স্ক্রিন ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাবকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এই পরিবর্তন বেশ গুরুত্বপূর্ণ যেটাকে মানুষ তখন গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছিল না। এখন অনেকেই একে আরো গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। তবে স্ক্রিনের খারাপ দিক নিয়ে যেসব সতর্কতা রয়েছে, সেগুলো হয়তো পুরো সত্যটা বলে না।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিনফিল্ডের মস্তিষ্ক সংক্রান্ত দাবিগুলো প্রমাণভিত্তিক নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে ছিলো না। তাই এই দাবিগুলো অভিভাবক ও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।এখন যুক্তরাজ্যের আরেকদল বিজ্ঞানী বলছেন, স্ক্রিনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব রয়েছে। তাহলে আমাদের সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করা এবং তাদের ট্যাবলেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারে বাধা দেওয়ার বিষয়টাকে কি আমরা ভুলভাবে দেখছি?
এটা কি সত্যিই যতটা খারাপ মনে হয়, ততটাই খারাপ?
বাথ স্পা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক পিট এটচেলস, সেই গবেষকদের একজন, যিনি বলছেন এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তিনি স্ক্রিন টাইম ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে শত শত গবেষণা বিশ্লেষণ করেছেন, তরুণদের স্ক্রিন ব্যবহার সম্পর্কিত অনেক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি তার আনলকড: দ্য রিয়েল সায়েন্স অব স্ক্রিন টাইম বইতে, বলেছেন, সংবাদমাধ্যমে যেসব জোরালো শিরোনাম হয় সেসবের পেছনের বিজ্ঞান আসলে অনেক মেশানো এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভুলভ্রান্তিতে ভরা। স্ক্রিন টাইমের ভয়াবহ ফলাফল নিয়ে যেসব গল্প বলা হয়, তা সমর্থন করার জন্য যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আসলে নেই।
২০২১ সালে আমেরিকান সাইকোলজি অ্যাসোসিয়েশন যেই গবেষণা প্রকাশ করেছে, তাও একই কথা বলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ১৪ জন লেখক, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রকাশিত ৩৩টি গবেষণা বিশ্লেষণ করেন। তারা দেখতে পান, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ও ভিডিও গেমসহ স্ক্রিন ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় খুব সামান্য ভূমিকা রাখে। কিছু গবেষণা বলেছে, স্ক্রিন থেকে নির্গত ব্লু লাইট ঘুম আসা কঠিন করে তোলে কারণ এটি মেলাটোনিন হরমোন যা কিনা ঘুমের হরমোন, সেটাকে দমন করে। কিন্তু ২০২৪ সালের বিশ্বব্যাপী ১১টি গবেষণার একটি পর্যালোচনায় মোটাদাগে কোনো প্রমাণ মেলেনি যে ঘুমের আগের এক ঘণ্টা স্ক্রিনের আলো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়।
বিজ্ঞানের সঙ্গে যেসব সমস্যা রয়েছে
প্রফেসর এটচেলস বলেন, স্ক্রিন টাইম নিয়ে যেসব তথ্য উপাত্ত রয়েছে, তার বেশিরভাগই নিজে বলার ভিত্তিতে বা আত্মপ্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে, এটাই একটি বড় সমস্যা। অন্যভাবে বললে, গবেষকরা কেবল তরুণদেরকে জিজ্ঞেস করেন তারা কতক্ষণ ধরে স্ক্রিন ব্যবহার করেছে এবং এটা নিয়ে তাদের অনুভূতি কী। তিনি আরো বলেন, এই বিশাল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করার লাখ লাখ পদ্ধতি থাকতে পারে। দুটো বিষয়কে যোগ করার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক হতে হবে।গ্রীষ্মকালে আইসক্রিম বিক্রি ও ত্বকের ক্যানসারের উপসর্গ উভয়ই পরিসংখ্যানগতভাবে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে।
এখানে আইসক্রিম ও ত্বকের ক্যানসার দুটো বিষয়ই গরম আবহাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এদের একটির সাথে অপরটির কোন সম্পর্ক নেই। আইসক্রিম স্কিন ক্যান্সারের কারণ নয়। তিনি আরো একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করেন, যা একজন ডাক্তার বা জেনারেল প্র্যাকটিশনার দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। প্রথমত, ওই চিকিৎসক লক্ষ্য করেছিলেন যে তরুণদের সঙ্গে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ নিয়ে আগের চেয়ে বেশি কথা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তিনি দেখেছিলেন যে অনেক তরুণ অপেক্ষাকক্ষে বসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। তাই আমরা ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করি এবং বলি, ঠিক আছে, এটা পরীক্ষা করি, ডেটা ব্যবহার করে এই সম্পর্কটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। যদিও বিষণ্ণতা ও ফোন ব্যবহারের মধ্যে একটা সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিল, তবে গবেষণায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধরা পড়ে। সেটা হলো যারা বিষণ্ণ বা উদ্বিগ্ন, তারা কতটা সময় একা কাটায়। শেষ পর্যন্ত গবেষণায় দেখা যায়, মানসিক সমস্যার মূল কারণ ছিল একাকীত্ব, শুধু স্ক্রিন টাইম নয়।
নেগেটিভ স্ক্রলিং বনাম ইতিবাচক স্ক্রিন টাইম
তারপর আসে স্ক্রিন টাইমের প্রকৃতি নিয়ে এমন কিছু তথ্য যা নিয়ে বিষদ আলোচনা হয়নি। প্রফেসর এটচেলস বলেন, স্ক্রিন টাইম শব্দটি খুবই অস্পষ্ট বা ধোঁয়াটে। সেটা কি আনন্দদায়ক স্ক্রিন টাইম ছিল? কাজে লাগার মতো উপকারী কিছু ছিল? তথ্যবহুল ছিল? নাকি ছিল শুধু ডুমস্ক্রলিং (নেতিবাচক খবর একটার পর একটা দেখা)? ওই তরুণ কি একা ছিল, না কি অনলাইনে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল? প্রতিটি অভিজ্ঞতা একেক রকম অনুভব তৈরি করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক নয় থেকে ১২ বছর বয়সী সাড়ে ১১ হাজার শিশুর মস্তিষ্কের স্ক্যান, স্বাস্থ্য-পরীক্ষা ও তাদের নিজের বলা স্ক্রিন টাইম একসাথে বিশ্লেষণ করেন। যদিও স্ক্রিন ব্যবহারের ধরণে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সংযোগে কিছু পরিবর্তন দেখা গেছে, তবুও এই গবেষণায় কোনো প্রমাণ মেলেনি যে স্ক্রিন টাইম মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি বা বুদ্ধিগত সমস্যার কারণ। এমনকি যেসব শিশু দিনে কয়েক ঘণ্টা স্ক্রিন ব্যবহার করত, তাদের ক্ষেত্রেও না। যারা দিনে কয়েক ঘণ্টা স্ক্রিন ব্যবহার করতো, তাদের ক্ষেত্রেও না।
এই গবেষণা ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত চালানো হয়, এটি তত্ত্বাবধান করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু প্রিজবিলস্কি, যিনি ভিডিও গেম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার পর্যালোচিত গবেষণাগুলোর তথ্য মতে, এগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি না করে বরং উন্নত করতে পারে। অধ্যাপক এটচেলস বলেন, যদি আপনি ভাবেন যে স্ক্রিন আসলেই মস্তিষ্কের ক্ষতি করে, তাহলে এমন বড় ডেটাসেটে তার প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যেত। কিন্তু সেটা দেখা যায় না… তাই বলা যায় যে স্ক্রিন সবসময় বা দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কের ক্ষতি করছে, এটা সত্যি বলে মনে হয় না।
এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির ব্রেইন স্টিমুলেশন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ক্রিস চেম্বার্সও। তিনি প্রফেসর এটচেলসের বইয়ে উদ্ধৃত হয়ে বলেন, “যদি মস্তিষ্কের অবনতি ঘটত, তাহলে সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা যেত। গত ১৫ বছরের গবেষণাগুলো দেখলেই সেটা ধরা পড়ত… যদি পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে আমাদের মস্তিষ্ক এতটা দুর্বল হতো, তাহলে আমরা বহু আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম।
মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ঙ্কর এক সমীকরণ
অনলাইনের কিছু গুরুতর ক্ষতি যে আছে, সেটা অধ্যাপক প্রিজিবিলস্কি বা অধ্যাপক এটচেলস কেউই অস্বীকার করছেন না। যেমন, শিশুদের টার্গেট করে প্রতারণা বা যৌন হয়রানি ঘটনা, অনলাইনে অশ্লীল বা ক্ষতিকর কনটেন্টে সহজে দেখার সুযোগ। তবে তাদের দুজনেরই মত, স্ক্রিন টাইম নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা এই ভয়াবহ বিষয়গুলোকে আরও গোপনে হারিয়ে যাওয়া বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পথে ঠেলে দিতে পারে।
শঙ্কা প্রকাশ করে প্রফেসর প্রিজিবিলস্কি বলেন, এখন অনেকেই ডিভাইস ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা বলছেন। তবে স্ক্রিন টাইম যত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা স্ক্রিনকে নিষিদ্ধ ফল-এর মতো আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। তবে অনেকে এতে দ্বিমত পোষণ করেন। যুক্তরাজ্যের প্রচারণা দল স্মার্টফোন ফ্রি চাইল্ডহুড (স্মার্টফোন মুক্ত শৈশব) বলেছে, এখন পর্যন্ত দেড় লাখ মানুষ এক প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ১৬ বছর বয়সের আগে না দেয়া।
সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, জিন টোয়েনজি যখন যুক্তরাষ্ট্রের কিশোরদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধির হার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তখন শুরুতে তার এই উদ্দেশ্য ছিল না এটা প্রমাণ করা যে সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্টফোন ভয়ানক কিছু। কিন্তু তিনি দেখলেন— এটাই ছিল একমাত্র মিল বা বা কমন ডিনোমিনেটর অর্থাৎ সাধারণ উপাদান । আজ তিনি মনে করেন, শিশুদেরকে স্ক্রিন থেকে আলাদা রাখা একেবারেই স্পষ্ট ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত, এবং তিনি অভিভাবকদের আহ্বান জানান সন্তানদের যতটা সম্ভব স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখতে। তিনি বলেন, ১৬ বছর বয়সে শিশুদের মস্তিষ্ক বেশি পরিপক্ব ও বিকশিত হয় এবং ১৬ বছর বয়সে স্কুল ও বন্ধুবান্ধবদের সামাজিক পরিবেশও ১২ বছরের তুলনায় অনেক স্থিতিশীল থাকে। যদিও, তরুণদের স্ক্রিন ব্যবহারের তথ্য বেশিরভাগ তারা নিজেরাই জানিয়েছে, তারপরও তিনি মনে করেন এতে তথ্যের গুরুত্ব কমে না।
২০২৪ সালে প্রকাশিত ডেনমার্কের এক গবেষণায় ৮৯টি পরিবারের ১৮১ শিশু অংশ নেয়। তাদের মধ্যে অর্ধেক শিশুকে দুই সপ্তাহের জন্য, সপ্তাহে মাত্র তিন ঘণ্টা করে স্ক্রিন ব্যবহার করতে দেয়া হতো। এরপর তাদের ট্যাবলেট ও স্মার্টফোন জমা দিতে বলা হয়। এই গবেষণায় দেখা যায়, স্ক্রিন টাইম কমানোয় শিশু ও কিশোরদের মানসিক উপসর্গের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সেইসাথে তাদের আচরণ আগের চাইতে সহানুভূতিশীল হয়েছে। যদিও তারা আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করে। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের স্ক্রিন ব্যবহারের সময় ডায়রিতে লিখে রাখতে বলা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, মেয়েদের মধ্যে যারা সোশ্যাল মিডিয়া বেশি ব্যবহার করে, তারা বেশি বিষণ্ণতায় ভোগে। প্রফেসর টোয়েনজি বলেন, এই সূত্রটা ধরুন: অনলাইনে বেশি সময় কাটানো মানে, সাধারণত একা স্ক্রিনের সামনে সময় কাটানো; এতে ঘুম কম হয়; বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি সময় কাটানোর সুযোগ কমে যায়— এটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়ঙ্কর সমীকরণ। আমি বুঝতে পারি না, এটা বিতর্কিত কেন মনে হয়।
অভিভাবকদের মধ্যে বিচার-বিশ্লেষণ
অধ্যাপক এটচেলসের সঙ্গে আমার কথা হয় ভিডিও চ্যাটে। কথাবার্তার মাঝখানে তার এক সন্তান আর কুকুরটি ঘরের ভেতরে-বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি—স্ক্রিন কি সত্যিই শিশুদের মস্তিষ্ক নতুনভাবে গঠন করছে? তিনি হেসে বলেন, সবকিছুই মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে, এভাবেই মানুষ শেখে। তবুও তিনি স্পষ্টভাবে অভিভাবকদের ভয় বা উদ্বেগের প্রতি সহানুভূতিশীল যে স্ক্রিন ক্ষতি করতে পারে। সমস্যা হলো, এই বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই, আর যেটুকু আলোচনা হচ্ছে তাও পক্ষপাত, দোষারোপ আর বিচার-বিশ্লেষণে ভরা।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু চিকিৎসক, জেনি র্যাডেস্কি বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। দাতা প্রতিষ্ঠান ডানা ফাউন্ডেশনে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, অভিভাবকদের মধ্যে জাজমেন্টাল বা বিচারধর্মী আলোচনা ক্রমেই বাড়ছে। মানুষ যা কিছু বলছে, তা গবেষণার নির্যাস তুলে ধরার বদলে বরং অভিভাবকদের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি করছে বেশি। এটা একটা বড় সমস্যা। পেছনে তাকিয়ে দেখি, তখন আমার ছোট সন্তানের আইপ্যাড নিয়ে রাগারাগি আমাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, তবে পরে ভেবে দেখি, স্ক্রিন ছাড়া অন্য খেলাধুলা নিয়েও সে একইরকম রাগ করেছে অনেকবার। যেমন, ভাইদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত থাকার সময় তাকে ঘুমাতে পাঠানো নিয়ে একই রকম নাটক করেছিল। অন্য অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলার সময় স্ক্রিন টাইম প্রসঙ্গ প্রায়ই উঠে আসে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অনেক বেশি কড়াকড়ি করেন, কেউ কেউ ছাড় দেন।
সরকারি নির্দেশনা এখনো অসামঞ্জস্যপূর্ণ
যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান একাডেমী অব পেডিয়াট্রিকস বা যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অব পেডিয়াট্রিকস অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ কোনোটিই শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট স্ক্রিন টাইম বেঁধে দেয়নি। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এক বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো স্ক্রিন টাইমই থাকা উচিত না, আর চার বছরের নিচের শিশুদের জন্য দিনে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা (যদিও এটি আসলে শিশুদের বসে না থেকে বেশি বেশি শারীরিক কসরত করাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলা হয়েছে)। এখানে বড় সমস্যা হলো, বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই, যাতে একেবারে নির্দিষ্ট পরামর্শ দেওয়া যায়। আর এটাই বিজ্ঞানীদের মধ্যেও মতপার্থক্য তৈরি করছে, যদিও সমাজের একটা বড় অংশ শিশুদের স্ক্রিন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। যদি নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকে তাহলে কী আমরা এমন একটা অসম প্রতিযোগিতার মাঠ তৈরি করছি? যেখানে একদল শিশু বড় হয়ে উঠছে প্রযুক্তি দক্ষ হয়ে, আরেকদল পিছিয়ে থাকছে—আর পরবর্তীতে হয়তো তারাই আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে?
যেভাবেই হোক, ঝুঁকিটা বড়। যদি স্ক্রিন সত্যিই শিশুদের ক্ষতি করে, তবে সেটার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আসতে আরো অনেক বছর লেগে যেতে পারে। আর যদি পরে প্রমাণ হয় স্ক্রিন আসলে তেমন ক্ষতিকর নয়—তাহলে আমরা হয়তো অপ্রয়োজনীয় ভীতির পেছনে প্রচুর সময়, শক্তি ও অর্থ ব্যয় করেছি, এবং এর মধ্যেই শিশুদের এমন একটি জিনিস থেকে দূরে রেখেছি যা উপকারীও হতে পারত। এর মধ্যে, প্রযুক্তিও থেমে নেই। স্ক্রিন এখন চশমার আকারে আসছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, আর মানুষ হোমওয়ার্ক থেকে শুরু করে মানসিক সহায়তা নিতেও এআই চ্যাটবট ব্যবহার করছে। আমরা আমাদের সন্তানদের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিই বা না দিই, এগুলো কিন্তু দ্রুতই আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছে।