পর্তুগালে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটি এখন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীদের জন্য ইউরোপের দেশ পর্তুগাল হলো “স্বপ্নপুরী”।
ইউরোবাংলার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে পর্তুগাল বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও দীর্ঘদিনের প্রবাসী রাজনীতিক এম এ হাকিম মিনহাজ তুলে ধরেছেন তাঁর প্রবাসযাত্রা, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার গল্প, পর্তুগালে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির চ্যালেঞ্জ এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতি তার প্রত্যাশা।
পাশাপাশি তিনি আলোচনা করেছেন প্রবাসীদের অধিকার, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা এবং পর্তুগালে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শেখ আশরাফুল ইসলাম।
ইউরোবাংলা : প্রথমেই জানতে চাই, আপনি কবে থেকে পর্তুগালে প্রবাস জীবন শুরু করেন এবং কীভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : আমি প্রথমে ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যে আসি। সেখানে পড়াশোনা ও কাজের পাশাপাশি দেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। পরে ২০১৪ সালে পর্তুগালে আসি এবং তখন থেকেই পর্তুগাল বিএনপির কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হই। বিএনপির আদর্শ, দেশপ্রেম ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাস থেকেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হই।
ইউরোবাংলা : আপনি পর্তুগালে বিএনপির দায়িত্বশীল পদে কীভাবে যুক্ত হলেন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : ২০১৪ সালের পর্তুগাল বিএনপি কমিটিতে আমি সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সেই সময় থেকেই আমি সংগঠনের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে আহ্বায়ক কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি এবং সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করছি।
ইউরোবাংলা : বর্তমানে পর্তুগালে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি কোন সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে আপনি মনে করেন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো লিগ্যালাইজেশন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও নতুন অভিবাসন নীতির অস্পষ্টতা। বিশেষ করে বর্তমান মধ্য-ডানপন্থী সরকার এবং বিরোধী কিছু দলের অভিবাসীবিরোধী মনোভাবের কারণে প্রবাসীরা নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। নতুন প্রবাসীরা এসব কারণে নানা কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
ইউরোবাংলা : বসবাসের বৈধতা, কাজের সুযোগ, এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি—এই তিনটি বিষয়ে প্রবাসীদের অবস্থা কীভাবে দেখেন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : আমি মনে করি, ভাষা শিক্ষা ও স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ালে আমাদের কমিউনিটি আরও দ্রুত মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।
ইউরোবাংলা : পর্তুগালে আসা নতুন প্রবাসীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
এম এ হাকিম মিনহাজ : প্রথমেই ধৈর্য ধরতে হবে। পর্তুগালের আইন-কানুন বুঝে, ভাষা শিখে, সঠিকভাবে কাজ শুরু করতে হবে। যারা আগেই এখানে আছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আইনি পরামর্শ নেওয়াটা খুব জরুরি।
ইউরোবাংলা : পর্তুগালে বাংলাদেশি কমিউনিটি এখন বেশ বড়, একে আরও ঐক্যবদ্ধ করতে কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : আমরা যদি রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে একে অপরের পাশে দাঁড়াই, তাহলে কমিউনিটি আরও শক্তিশালী হবে। প্রবাসে একে অপরকে সহায়তা করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা—এসবই ঐক্য বৃদ্ধি করে।
ইউরোবাংলা : কমিউনিটির তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি আগ্রহ কেমন? তাদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে কী উদ্যোগ প্রয়োজন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : তরুণদের মধ্যে আগ্রহ আছে, তবে তা সংগঠিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও পর্তুগিজ ভাষা চর্চায় যুক্ত করতে। এজন্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, সেমিনার ও অনলাইন সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি তাদেরকে পর্তুগালের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্যও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ইউরোবাংলা : প্রবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন কি কমিউনিটির অগ্রগতিতে বাধা তৈরি করছে?
এম এ হাকিম মিনহাজ : হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে তা বাধা তৈরি করে। তবে আমরা চেষ্টা করছি রাজনৈতিক মতভেদকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে রাখার। রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও প্রবাসে পারস্পরিক শ্রদ্ধা জরুরি। আমাদের সবার লক্ষ্য একটাই — দেশের কল্যাণ ও প্রবাসীদের মর্যাদা বৃদ্ধি।
ইউরোবাংলা : বিএনপির পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : খুবই ভালো। আমি বিশ্বাস করি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো একে অপরের পরিপূরক। তাই আমরা সব সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখি।
ইউরোবাংলা : বিদেশে থাকা প্রবাসীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : প্রবাসীরা দেশের জন্য অর্থনৈতিক অবদান রাখছেন, পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আমরা গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও সুশাসনের পক্ষে জনমত তৈরি করতে পারি। বিদেশে বসেও দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব।
ইউরোবাংলা : বিএনপি পর্তুগাল শাখা কীভাবে প্রবাসীদের অধিকার ও জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলছে?
এম এ হাকিম মিনহাজ : আমরা নিয়মিত সভা, মানববন্ধন ও অনলাইন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রবাসীদের অভিবাসন, কাজ, ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রবাসীদের অবহিত রাখছি।
ইউরোবাংলা : বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে প্রবাস বিএনপির ভূমিকা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : প্রবাস বিএনপি দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে ধরছি, যা দেশীয় আন্দোলনকে শক্তি জোগায়।
ইউরোবাংলা : প্রবাসে থেকেও দেশের রাজনীতিতে আপনারা কীভাবে ভূমিকা রাখেন?
এম এ হাকিম মিনহাজ : আমরা প্রচারণা, মতামত গঠন ও আন্তর্জাতিক সংযোগের মাধ্যমে ভূমিকা রাখি। দেশে যারা সংগ্রাম করছেন, তাদের প্রতি সমর্থন জানানোই আমাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব।
ইউরোবাংলা : ভবিষ্যতে পর্তুগাল বিএনপিকে আরও শক্তিশালী করতে আপনার পরিকল্পনা কী?
এম এ হাকিম মিনহাজ : আমাদের লক্ষ্য হলো সংগঠনকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক করা, তরুণ নেতৃত্ব গড়ে তোলা এবং প্রবাসীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা।
ইউরোবাংলা : সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রবাসীদের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। আপনার অনুভূতি কী?
এম এ হাকিম মিনহাজ : এটি অত্যন্ত ইতিবাচক উদ্যোগ। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির বড় অংশীদার, তাই তাদের ভোটাধিকার দেওয়া ন্যায্য ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
ইউরোবাংলা : আপনি ব্যক্তিগতভাবে প্রবাসীদের উন্নয়ন বা কল্যাণে কোনো সামাজিক উদ্যোগ নিচ্ছেন কি?
এম এ হাকিম মিনহাজ : জি, আমি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সংগঠিত করতে কাজ করছি। বর্তমানে আমি প্রচেষ্টায় আছি, যাতে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয় এবং প্রবাসীরা ব্যবসায়িকভাবে এগিয়ে যেতে পারেন। তার পাশাপাশি প্রবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য আমি Probashi Odhikar Council, Casa do Bangladesh, Jalalabad Association সহ বহু সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছি।
ইউরোবাংলা : তরুণ প্রজন্ম ও নতুন প্রবাসীদের জন্য আপনার বার্তা কী হবে?
এম এ হাকিম মিনহাজ : দেশপ্রেম, সততা ও পরিশ্রমের বিকল্প নেই। নতুন প্রবাসীরা যেন হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন—এই বার্তাই আমি দিতে চাই।
ইউরোবাংলা : পর্তুগালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও নিশ্চয়ই আছেন, বর্তমানে তাদের অবস্থা কী?
এম এ হাকিম মিনহাজ : হ্যাঁ, তারা আছে এবং তারাও নিজ নিজ মতাদর্শ অনুযায়ী কাজ করছেন। আমরা সবাই চাই প্রবাসে বাংলাদেশের সুনাম বজায় থাকুক, তাই রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা উচিত।
ইউরোবাংলা : শেষ প্রশ্ন, আপনি যদি বাংলাদেশের সরকার বা নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান, সেটা কী হবে?
এম এ হাকিম মিনহাজ : আমি বলব — প্রবাসীরা শুধু রেমিট্যান্স প্রেরক নয়, তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভাবমূর্তির দূত। তাই তাদের নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার, ও দূতাবাস সেবার মান বাড়াতে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
ইউরোবাংলা : আমাদেরকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এম এ হাকিম মিনহাজ : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।