১৪ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মিথ্যা: ব্যক্তিগত ত্রুটি নয়, সমাজ ধ্বংসের হাতিয়ার

আবদুল আহাদ সালমান


মিথ্যা এমন এক অভ্যাস যা মানুষের চরিত্রকে কলুষিত করে, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি ডেকে আনে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক দিয়েছেন, যাতে সে সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। কিন্তু যখন মানুষ মিথ্যা বলে, তখন সে নিজের এই মর্যাদাকে পদদলিত করে। এজন্যই ইসলাম ধর্মে মিথ্যা বলা একটি গুরুতর গুনাহ আর মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ ঘৃণা করেন।

পবিত্র কুরআনের আলোকে মিথ্যার ভয়াবহতা :

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বারবার মিথ্যার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে পথপ্রদর্শন করেন না। (সূরা মুমিন, আয়াত ২৮)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ১১৯)

এই আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় সত্যবাদিতা একজন মুমিনের পরিচয়, আর মিথ্যা বলা মুমিনের গুণ নয়।

আল্লাহ আরও বলেন, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ৩৬)

অর্থাৎ অনুমান বা কল্পনার ভিত্তিতে কথা বলা ইসলাম অনুমোদন করে না। কারণ এভাবে বললে তা মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়।

আরও বলা হয়েছে, অবশ্যই মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৬১)

এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে মিথ্যা শুধু নৈতিক ত্রুটি নয়, বরং এটি এমন অপরাধ যা আল্লাহর লানত ও ক্রোধের কারণ হয়।

হাদীসের আলোকে মিথ্যার পরিণতি :

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিথ্যাকে সব পাপের মূল বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন

সত্য মানুষকে পুণ্যের পথে পরিচালিত করে, আর পুণ্য মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যায়। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে, আর পাপ মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

আরও বর্ণিত হয়েছে, যখন মানুষ মিথ্যা কথা বলে, তখন মিথ্যার দুর্গন্ধে ফেরেশতারা তার থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়। (তিরমিজি, হাদীস ১৯৭২)

অন্য এক ভয়াবহ বর্ণনায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখেছেন, এক ব্যক্তির মুখ চোয়াল পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। বলা হলো এই ব্যক্তি মিথ্যা বলত, তার মিথ্যা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ত। তাই কিয়ামত পর্যন্ত এ শাস্তি তার জন্য নির্ধারিত।” বুখারী, হাদীস ১৩৮৬

মিথ্যা: মুনাফিকের লক্ষণ

মিথ্যা বলা শুধু গুনাহ নয়, এটি মুনাফিকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। (সূরা মুনাফিকুন, আয়াত ১)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে: কথা বললে মিথ্যা বলে, প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করে, আর আমানত রাখলে খেয়ানত করে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

অতএব, মিথ্যা বলা কোনো সামান্য দোষ নয়; এটি এমন বৈশিষ্ট্য যা একজন মুমিনের অন্তরে স্থান পায় না।

মিথ্যার সামাজিক ও ব্যক্তিগত ক্ষতি :

মিথ্যা শুধু ব্যক্তিকে নয়, পুরো সমাজকেই ধ্বংস করে। একটি মিথ্যা পারিবারিক সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে, বন্ধুত্বে অবিশ্বাস জন্মাতে পারে, এমনকি বিচারব্যবস্থার ন্যায়পরায়ণতাও ধ্বংস হতে পারে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, আর যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না, তারাই আল্লাহর প্রকৃত বান্দা। (সূরা ফুরকান, আয়াত ৭২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে বলেছেন, আমি যার পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে কোনো রায় দিই, সে যেন জাহান্নামের আগুনের টুকরো গ্রহণ না করে। (বুখারী, হাদীস ২৪৫৮)

মিথ্যার আধ্যাত্মিক ক্ষতি :

মিথ্যা মানুষের অন্তরকে অন্ধ করে দেয়। অন্তর যখন মিথ্যার বিষে আক্রান্ত হয়, তখন সত্য ও অসত্যের পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। মিথ্যাবাদী মানুষ হককে বাতিল ও বাতিলকে হক মনে করে। ফলে তার অন্তর ধ্বংস হয়ে যায়, আর সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে চলে যায়।

আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে মিথ্যা বলে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ৯০)

সত্যের মাহাত্ম্য :

যেমন মিথ্যা ধ্বংস ডেকে আনে, তেমনি সত্য মানুষকে আলোকিত করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে বিষয়ে সন্দেহ হয় তা পরিত্যাগ করো, আর যা নিশ্চিত তা গ্রহণ করো। সত্য হচ্ছে প্রশান্তি, আর মিথ্যা হচ্ছে সন্দেহ।” (তিরমিজি, হাদীস ২৫১৮)

সত্যবাদিতা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী, শান্ত ও সম্মানিত করে তোলে। কিয়ামতের দিনে সত্যবাদীরা আল্লাহর সামনে গর্বভরে দাঁড়াবে।

আজ সেই দিন, যেদিন সত্যবাদীদের সততা তাদের উপকারে আসবে। (সূরা মায়িদা, আয়াত ১১৯)

মিথ্যা বলা এমন এক নিকৃষ্ট অভ্যাস, যা মানুষের ঈমান, জ্ঞান, বিবেক, সমাজ ও আখিরাত সব কিছু ধ্বংস করে দেয়। মিথ্যা থেকে দূরে থাকা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি ঈমানের দাবিও বটে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ১১৯)

তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যের অনুশীলন করতে হবে। সত্যবাদিতা মানুষকে জান্নাতের পথে নিয়ে যায়, আর মিথ্যা টেনে নেয় জাহান্নামের দিকে।

হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরকে সত্যবাদী করো, মুখকে মিথ্যা থেকে রক্ষা করো, এবং আমাদেরকে সেই বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করো, যারা সর্বদা সত্য কথা বলে ও সত্যের পথে অটল থাকে। আমিন।

লেখক : সম্পাদক, ইউরোবাংলা

লেখকের আরও প্রবন্ধ :সৎ বন্ধুত্ব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ