২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পাতা ঝরার দিনগুলো

শেখ আশরাফুল ইসলাম

রাবেয়া বেগম প্রস্তুত হচ্ছেন। ছেলে মঈন আহমদ ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি বের করতে। তিনিও প্রায় প্রস্তুত৷ স্যুট-কোট পরেছেন। স্ত্রী এসে গলায় টাই বেধে দিলেই তিনি বের হবেন। এই ভদ্রলোক রাজধানীর বড়সড় একটা কর্পোরেট হাউজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। গত মাসে সস্ত্রীক ব্যাংককে ঘুরতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মা’কে আর তাদের সাথে রাখবেন না।

মঈন আহমেদের স্ত্রীর নাম সাবিহা। শাশুড়ীর খক খক কাশি আর বিরক্তিকর পান চিবানো সহ্য করতে পারেন না তিনি। তাছাড়া তাদের ছেলেমেয়েদের সুস্থ পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার পেছনে নিজের শাশুড়ীকে একমাত্র বাধা মনে করেন মঈন আহমেদের স্ত্রী। ছেলের পরিপাটি সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারায় অনেক সময় পুত্রবধূ কর্তৃক অপমানের শিকার হতে হয় বৃদ্ধা রাবেয়া বেগমকে। মঈন আহমেদ প্রবল আত্মমর্যাদার অধিকারী। তার মা তো আর যেই সেই বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পারে না। স্বামীর এই বিষয়টির প্রতি খেয়াল করে সাবিহা নিজেই খোঁজে বের করলেন আশ্রমের ঠিকানা। শাশুড়ীকে তিনি বুঝালেন, ওখানে অনেক ভালো থাকবেন তিনি। তাকে নিরিবিলি পরিবেশে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থ।

বৃদ্ধা রাবেয়া বেগমকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বেলকনি থেকে তাকিয়ে আছে তার পুত্রবধূ সাবিহা ও আদরের নাতিনাতনি আতিফা আর মানসূর। যেদিক দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, শহরের সেই রাস্তা অনেক স্মৃতির স্বাক্ষী। এই একই রাস্তায় মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেতেন ছোট্ট মঈন। সে আজ অনেক বড়। মা’য়ের সেই হাত শেষ কবে স্পর্শ করেছে, সেটি মনে পড়ছে না রাবেয়া বেগমের। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে পানি এলো। চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে তিনি ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, খোকা! আমায় কতদিন পর পর দেখতে আসবি? উত্তর নেই। আবারও তিনি বললেন, তুই যখন আসবি, অবশ্যই আতিফা আর মানসূরকে নিয়ে আসবি। মাঝে মাঝে তোর বাসায় নিয়ে যাস। আতিফা-মানসূরের কথা বড্ড মনে পড়বে।

আশ্রমে মা’কে রেখে মঈন আহমেদ সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরেছেন। তার স্ত্রী খুব খুশি। আজ সন্ধ্যায় আর শাশুড়ীর জন্য পানি গরম করতে হবে না কিংবা খক খক কাশি শুনতে হবে না। সন্তানদের পড়ার টেবিলে রেখে টিভিতে সিরিয়াল দেখতে বসেছেন সাবিহা। এখন আর কেউ নেই, যিনি কাছে ডেকে টিভি দেখতে নিষেধ করে নামাজের তাগিদ দেবেন। সেদিন রাতে খাবার টেবিলে মা’কে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে সাবিহার বড় ছেলে মানসূর বললেন, মা! দিদাকে কোথায় রেখে আসা হলো? বৃদ্ধ আশ্রমে বুঝি? আচ্ছা মা! তোমরা যখন বৃদ্ধ হবে আমরাও কি তখন এভাবে রেখে আসব? এসব শুনে মঈন আহমদ স্ত্রী’র দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় খাবার ছেড়ে উঠে গেলেন। এই ঘটনার পর এক মাস হলো মঈন আহমেদের বাসায় তার মা নেই। মা ছাড়া দুনিয়া উনার জন্য এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

হঠাৎ করেই চাকরি চলে যায় মঈন আহমদের। বিষয়টি জানতে পেরে প্রথম কিছুদিন সান্তনা দেয় স্ত্রী। কিন্তু দিনকে দিন সমস্যা আরও প্রবলভাবে বিঁধে যায় সংসারে। টানাপোড়েন শুরু হয় সাবিহার ঘরে। আর এসব বিষয় থেকে তৈরি হয় ঝগড়ার সূত্রপাত। দুনিয়া খুব তিতে মনে হয় এই দম্পতির। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের স্কুলে বেতন বকেয়া। চলতি মাসে পরিশোধ করতে না পারলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হবে। এমতাবস্থায় স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন বাপের বাড়ি চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার। ছেলে-মেয়ে নিয়ে তিনি চলে গেলেন।

ঈদুল ফিতরের আগের দিন। স্ত্রী-সন্তান কেউ নেই তার পাশে। সাবিহা ঈদ উপলক্ষে দুয়েকটা ফোনকল করেছে মাত্র। শশুর বাড়ি থেকে কোনোরকম দাওয়াত পেয়েছেন তিনি। কিন্তু জীবনের সেই জৌলুশ আর নেই। সব জায়গায় অবহেলিত মঈন আহমদ। বাবার রেখে যাওয়া টাকার উপর ভর করে যেই ফ্ল্যাট তিনি কিনেছিলেন, সেটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তার। মনে পড়ল মায়ের কথা। আকাশে ঈদের চাঁদ। সন্ধ্যার পর পর গিয়ে হাজির হলেন বৃদ্ধাশ্রমে। মা রাবেয়া বেগম তার কক্ষে বসে কাপড় সেলাই করছেন। সন্তানকে দেখা মাত্রই তিনি ছুটে এলেন কাছে। জানতে চাইলেন, বাসার সবাই কেমন আছে। সব খুলে বললেন মঈন আহমদ। দুজনেই কাঁদলেন। ক্ষমা চাইলেন মঈন আহমদ। মা’কে ফিরিয়ে আনলেন তার বাসায়।

ঈদের দু’দিন পর আলমারি থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে ছেলের হাতে দিলেন রাবেয়া বেগম। তিনি বেশকিছু টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার রেখেছেন ব্যাংকে। মঈন আহমদ সেগুলো তুলে নিয়ে আসলেন। মা বললেন, মঈন! বাবা আর চাকরি নয়, এবার ব্যাবসা শুরু কর। কিছুদিন পর তিনি ব্যাবসা শুরু করলেন। প্রিন্টিংপ্রেস দিলেন তিনি। নাম দিলেন “মা প্রিন্টার্স”। ওদিকে স্ত্রী-সন্তান চট্টগ্রামে তার শশুর বাড়ি। অনেক দিন হলো যোগাযোগ হয় না তাদের সাথে। তবে সেদিকে খুব একটা খেয়াল নেই মঈন আহমদের। তিনি ব্যাবসায় পরিপূর্ণ মনোযোগী হয়েছেন। আল্লাহ’র বরকতে ব্যাবসায় বেশ উন্নতি হলো।

মায়ের আদেশে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আসতে চট্টগ্রাম গেলেন মঈন আহমদ। সপ্তাহখানেক পর হঠাৎ কাজের মেয়েটি ফোন করে জানালেন তার মা ইন্তিকাল করেছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢাকায় ফিরলেন মঈন আহমদ। বনানীর কবরস্থনে দাফন করা হলো রাবেয়া বেগমকে। অনেকদিন পর শুধু মায়ের জন্য এতটা কাঁদলেন মঈন আহমদ। সবাই ছেড়ে যাওয়ার পর যেই মা তাকে আঁকড়ে নিলেন বুকে, তিনিই আর নেই। যন্ত্রণাদায়ক কাশি, পান চিবানো কিংবা নামাজের তাগিদ দেওয়ার জন্য আর কেউ রইল না।

মায়ের রুমে গিয়ে ছোট্ট একটা পুরনো ডায়েরি চোখে পড়ল মঈন আহমদের। ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলেন তিনি। ঠিক মাঝখানের একটা পাতায় লেখা, “তোমার বাবার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে একখণ্ড জমি আছে আমার নামে। সেই জমিতে একটা বৃদ্ধাশ্রম বানিও। তোমার মা’য়ের মতো অবহেলিত অনেক মা’য়ের আশ্রয় হবে সেখানে।” মঈন আহমদ হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলেন ফরিদপুর। ওখানে গিয়ে চাচার কাছ থেকে জমি বুঝে নিলেন তিনি। পরিকল্পনা বৃদ্ধাশ্রম তৈরির। ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনও করলেন।

মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে। নামাজে গেলেন মঈন আহমদ। মসজিদ থেকে এসে চেয়ার পেতে বসলেন আশ্রম তৈরির জমিটাতে। কিছুদিন পর এই জায়গাটি হবে অবহেলিত কিছু মা-বাবার আশ্রয়স্থল। তবে কেন যেন অস্বস্তি লাগছিল তার। তিনি ঢাকায় ফিরলেন। শহরের আশেপাশে প্রায় প্রতিটা বৃদ্ধাশ্রমে সফর করলেন। একটা বিষয়ে খুব আশ্চর্য হয়েছেন তিনি। আশ্রমগুলোতে বড়সড় আমলা-কামলাদের বাবা-মা থাকলেও সেখানে আলেমদের পিতামাতা নেই। তারা ভাগ্যবান।

মঈন আহমদ বাসায় ফিরে আবারও সেই ডায়েরি হাতে বসেছেন বেলকনিতে। ডায়েরির পাতায় পাতায় অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল মাস্টারের ছেলে মঈন আহমদের আবেগ ভরা শৈশব-কৈশর নিখুঁতভাবে লিখে রেখেছেন তার মা। সেসব পড়ে কখনো হাসছেন কখনো ভেতরে ভেতরে কাঁদছেন। মা কাছে থাকলে হয়তো জিজ্ঞেস করতেন, “এতটাই ভালোবাসতে আমায়?”। সেই সুযোগ আর নেই।

পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ আরও একটা গভীর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি পেলেন। সেখানে মঈন আহমদকে উদ্দেশ্য করে লেখা, ” আমি তোমাদের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না। আমার শাশুড়ি অর্থাৎ তোমার দাদিজানও পারতেন না কোন একসময়। আমি বিরক্ত ছিলাম নিজের শাশুড়ি আম্মার প্রতি। তোমার ফেরেশতাতূল্য স্কুলমাস্টার বাবাকে চাপ প্রয়োগ করে বাধ্য করেছিলাম তার মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে। ইদানীং আমার মনে হচ্ছে সেই শাস্তিটুকু দুনিয়া থেকেই ভোগ করে যেতে হবে আমাকে। সেটুকুর জন্য প্রস্তুত আমি। নিজের প্রতি কোনো দুঃখ নেই আমার। কেবল দুঃখ হচ্ছে তোমার স্ত্রী’র প্রতি। না জানি আবার তোমাদের আদরের সন্তান মানসূরের দ্বারায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়!” পৃষ্ঠার শেষাংশে লেখা, “পাতা ঝরার দিন”।

হঠাৎ তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বৃদ্ধাশ্রম নয়, সেখানে একটি কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবেন। অবহেলিত মা-বাবার চোখের পানি তিনি আর সহ্য করতে পারবেন না। অপরদিকে এখানে মাদরাসা হলে অনেক মা-বাবা দুনিয়া ও আখেরাতে সুখ-শান্তি লাভ করবেন। এই বোধ-বিশ্বাস থেকে তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। গ্রামে গিয়ে মহল্লায় ঘোষণা দিলেন, এখানে আশ্রম নয়, তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান মাদরাসা। গ্রামের সবাই এগিয়ে আসলেন। প্রতিষ্ঠা হলো মাদরাসা। যেন এক টুকরো জান্নাত। পরবর্তীতে স্ত্রী সাবিহার সাথে আলোচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের একমাত্র ছেলে মানসূরকে আলেম বানাবেন। মানসূর আলেম হচ্ছেন। তার মা-বাবার আর কোনো চিন্তা নেই। আশ্রমে যাওয়ার ভয় নেই।