আবুল আলা মাসুম
নাযর ইবনুল হারিস ছিলেন তাঁদের একজন, যারা নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে কষ্ট দিতেন এবং প্রকাশ্য শত্রুতা পোষণ করতেন। অন্যান্য শীর্ষ বিরোধিতাকারীদের মতো তিনিও রাসুল (সা.) এবং তার সাহাবীদেরকে নিয়মিত শারিরীক ও মানসিক টর্চার করতেন। কিন্তু এতে আশানুরুপ ফল না পাওয়াতে তিনি ইসলামের বিরোধিতা করতে, ইসলামকে মানুষের হৃদয়ে স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করতে নতুন পথ আবিষ্কারে মনোনিবেশ করেন।
প্রথমে তিনি রাসুল (সা.) এর দাওয়াতি কাজে বাধা দিতে হট্টগোলের পথ বেছে নেন। রাসুল সা. কোথাও কথা বললে তিনি সেখানে গিয়ে চীৎকার করতেন, সোরগোল করতেন, হট্টগোল পাকিয়ে ফেলতেন। যাতে সেখানে কথা বলার পরিবেশ নষ্ঠ হয়ে যায়। এ পদ্ধতি খুব বেশি ফলপ্রসূ হয় না। তিনি তখন বিকল্প ভাবতে শুরু করেন। রাসুল (সা.) এর বিরোধিতাকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন শুশীল বিরোধিতাকারী।
তিনি মুহাম্মাদ (সা.) এর কথা ও কাজকে গভীর ভাবে এনালাইসিস করতে শুরু করেন। মুহাম্মাদ (সা.) যা বলেন তার উপাদান বিশ্লেষণে মনোযোগী হন। তিনি দেখেন রাসুল সা. যাকে আল্লাহর বাণী বলছেন তার মধ্যে প্রাচীন সভ্যতার গল্প আছে।
প্রেক্ষিতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি আরব উপদ্বীপের উত্তর-পূর্বে যাবেন এবং ফারসিদের কাহিনি ও কিংবদন্তি সংগ্রহ করবেন যেন তিনি নবীজির আনা বাণীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেগুলি প্রচার করতে পারবেন।
তিনি ইরাকের “হীরা” শহরে যান, পারসিকদের গল্পগ্রন্থ পড়েন। যেমন, “কলিলা ও দিমনা” এবং তাঁদের কাহিনি ও মিথগুলো মুখস্থ করেন। রোমান ও পারসিক রাজাদের ইতিহাস, সোহরাব-রুস্তম ও ইস্পানদিয়ারের কাহিনি শিখে নেন।
মক্কায় ফিরে এসে তিনি এসব গল্প মানুষকে শুনাতে শুরু করলেন এবং বলতেন, “মুহাম্মদ কি আমার চেয়ে ভালো গল্প বলতে পারে?”
নবী মুহাম্মদ (সা.) পথে, প্রান্তরে, কাবা চত্বরে দাওয়াতের মজলিশ বসাতেন। সেখানে তিনি আল্লাহর পথে আহ্বান করতেন, ইসলাম প্রচার করতেন, কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং মানুষদের সাবধান করতেন আদ ও সামূদের পরিণতিসহ অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ইতিহাস বর্ণনা করতেন। তিনি তাঁর কওমকে সতর্ক করতেন— যেসব জাতি আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল, আল্লাহ তাদের ওপর শাস্তি নাজিল করেছিলেন।
নজর বিন হারিস তার কাছেই থাকতেন। নবী (সা.) উঠে গেলে নাযর ইবনুল হারিস সেখানে বসতেন এবং সে ফারসিদের থেকে শেখা কাহিনি ও কিংবদন্তি গল্প যেমন- সোহরাব রুস্তম ও ইস্পানদিয়ার এবং পারসিক রাজাদের গল্প বলতে শুরু করতেন।
এরপর সে বলতেন, “হে কুরাইশগণ! আল্লাহর কসম, আমি মুহাম্মদে) চেয়ে উত্তম গল্প বলি। এসো, আমি তোমাদের আরও ভালো গল্প শুনাই।”
সে এমনকি পেশাদার কাহিনিকারদের ভাড়া করেছিল, যারা গল্প বলত এবং তাদের কাজ ছিল— যারা মুহাম্মদ (সা.)-কে শুনতে এসেছিল, তাদের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়া।
সে বলত, “মুহাম্মদ তোমাদের আদ ও সামূদের কাহিনি বলেন, আর আমি বলি পারস্য ও রোমের কাহিনি।”
একবার সে নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে কুরআন তিলাওয়াত করতে শুনে বলল: “আমরাও তো চাইলে এমন কথা বলতে পারি! ওর কথা তো শুধু আগের লোকদের গল্প, যা সে অন্যের থেকে লিখে নিয়েছে— যেমন আমি নিয়েছি।”
এই বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ তা’আলা সূরা আল-আনফাল এর ৩১ নং আয়াত নাযিল করেন। وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَٰذَا ۙ إِنْ هَٰذَا إِلَّا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ
অর্থ: “যখন তাদের সামনে আমাদের আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, ‘আমরা শুনেছি, চাইলে আমরাও তো এমন বলতে পারি! এগুলো তো প্রাচীনদের কাহিনি ছাড়া আর কিছু নয়।’
“গল্প” বলা বিষয়টিকে তুচ্ছ বা ক্ষুদ্র ভাবার সুযোগ নেই। গল্প পাগল করেই মানুষকে আল্লাহ বানিয়েছেন। কোরানকে সহজ বোধ্য করার জন্যে আল্লাহ রাবুল আলামিন গল্প বলেছেন। ইউসুফ জুলেখার গল্প, আদ-সামুদের গল্প, বেহেশত দোজখের গল্প। ২৫জন নবীর গল্প।
মাত্র সাতশত বিধান সম্বলিত আয়াতকে মানুষের বোধগম্য করার জন্যে সেখানে ৬ হাজারের অধিক আয়াত তিনি নাজিল করেছেন।
নজর বিন হারিস এর এই “গল্প” বলার প্রবণতা থেকেই আজ হলিউড, বলিউডসহ দুনিয়ার তাবত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্ম। দুনিয়ার সব নাটক সিনেমা যার ধারাবাহিকতায় জন্ম নিয়েছে। যে গল্প মানুষকে দ্বীন থেকে সরিয়ে দুনিয়ামূখি করেছে। যে গল্প মানুষকে স্রস্ট্রার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, রাখছে।
নজর বিন হারিস এর হাত ধরে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
চলবে…
লেখক : গীতিকার, সুরকার ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব