আবদুল আহাদ সালমান
সুখ–দুঃখ, আশা–নিরাশা এবং পরীক্ষা–নিরীক্ষার সমন্বয়েই মানুষের জীবন। আমাদের চলার পথে কখনো ঝড় আসে, কখনো আবার রোদ–মেঘের খেলা। পুরো এই জীবনযাত্রায় ধৈর্য বা সবর হলো মানুষের অন্যতম আশ্রয়, শক্তি ও সাফল্যের ভিত্তি।
বাংলা এক প্রবাদে বলা হয়েছে, “সবুরে মেওয়া ফলে।” অর্থাৎ ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহ তাআলা সুন্দর ফল ও সুসংবাদ দান করেন।
ধৈর্য কী?
ধৈর্য বা সবর হলো এমন একটি মানসিক শক্তি, যা অন্তরকে অস্থিরতা থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ থেকে এবং দেহকে অসহায়তা প্রকাশ থেকে বিরত রাখে।
বিখ্যাত বুযুর্গদের কথায় ধৈর্যের ব্যাখ্যা আরও স্পষ্ট হয়। জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.) বলেছেন, হাসিমুখে তিক্ততার ঢোক গেলা। জুন্নুন মিসরী রহ.: বলেছেন, আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা, বিপদের সময় শান্ত থাকা এবং দারিদ্র্যেও অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা।
সুতরাং ধৈর্যের সারমর্ম, বিপদে স্থির থাকা, সুখে কৃতজ্ঞ থাকা দুঃসময়ে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা।
ধৈর্যের তিনটি প্রধান দিক
১। ইবাদাতে ধৈর্য
নামাজ, রোজা, কুরআন পাঠ, দান খয়রাত সবই ধৈর্য, স্থিরতা এবং নিয়মিততার দাবি রাখে।
২। গুনাহ ও হারাম থেকে দূরে থাকার ধৈর্য
নফসের লালসা, শয়তানের প্রলোভন এবং সমাজের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করা এটিও ধৈর্যের এক কঠিন পরীক্ষা।
৩। তাকদীরের ভালো মন্দে স্থির থাকা
জীবনের উত্থান পতন, স্বাস্থ্য–অসুস্থা, সম্পদ–দারিদ্র্য সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। একমাত্র ঈমানদারই এসব ক্ষেত্রে ধৈর্যের সৌন্দর্য দেখাতে সক্ষম।
লুকমান আলাইহিস সালাম তার সন্তানকে উপদেশ দিয়েছিলেন, হে প্রিয় সন্তান, নামাজ কায়েম করো, সৎকাজে আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ করো এবং যা তোমার ওপর আসে, তাতে ধৈর্য ধরো। এটাই দৃঢ় সংকল্পের কাজ।
পবিত্র কুরআনে ধৈর্যের মর্যাদা :
সুরা আজ–জুমরের ১০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেয়া হবে, কোনো হিসাব ছাড়াই।”
সূরা আল আনফাল ৪৬ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গী।” একই সূরায় আল্লাহ বলেছেন, “ধৈর্য ও তাকওয়া শত্রুর ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।”
সুরা আল–আনফাল ১২০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা যদি ধৈর্য ধরো ও তাকওয়া অবলম্বন করো, তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।”
সুরা বাকারাহতে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, “তাদের ওপরই রয়েছে আল্লাহর দোয়া ও রহমত, তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত।”
হাদিসে ধৈর্যের শিক্ষা :
হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে বিপদে পড়ে ‘ইন্না লিল্লাহ’ বলে আল্লাহর কাছে প্রতিদান চায়—আল্লাহ তাকে উত্তম কিছু দান করেন।”
অপর হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার প্রতি মেহেরবান হন, তাকে পরীক্ষা দেন।”
কাঁটার আঁচড়েও সওয়াবের কথা বলা হয়েছে হাদিসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুমিনের প্রতি যে কোনো কষ্ট এমনকি কাঁটার খোঁচাও তার গুনাহ মোচন করে।”
অসুস্থতা ও ভ্রমণের অবস্থাতেও নেকি পাওয়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “অসুস্থতা বা সফরে তার সুস্থ অবস্থার আমলের সমান নেকি লেখা হয়।”
বুজুর্গদের উপদেশ ও অনুপ্রেরণা :
উম্মে সালামা (রা.) বলেছেন, “বিপদের সময় ধৈর্যধারণ করলে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দেন।” উরওয়া ইবন যুবাইর (রা.) বলেছেন, “আল্লাহ আমাকে ধৈর্যের জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন আমি কি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারি?”
উমর ইবন আবদুল আজীজ (রহ.) বলেছেন, যদি আল্লাহ কোনো নেয়ামত তুলে নেন এবং তার জায়গায় ধৈর্য দেন এটাই উত্তম নেয়ামত।
প্রতিদিনের জীবনে ধৈর্য :
ধৈর্য শুধু বড় বিপদে নয়, দৈনন্দিন জীবনের নানা পর্যায়েই প্রয়োজন। প্রতিবেশীর আচরণ সহ্য করা, পরিবারের ছোটখাটো ভুল ক্ষমা করা, স্বামী–স্ত্রীর পারস্পরিক ত্রুটি সহনশীলতা, কর্মস্থলে অধীনস্থদের ভুল–ত্রুটি ক্ষমা করা।
ধৈর্য মানুষকে গঠন করে, নৈতিকতা বৃদ্ধি করে, হৃদয়কে শান্ত করে এবং মানুষের চরিত্রকে সুসংহত করে।
ধৈর্য বা সবর হলো জীবনের শক্তি, মানসিক আশ্রয় এবং আখেরাতের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি। এটি বিপদের সময় স্থিরতা এনে দেয়, সুখের সময় কৃতজ্ঞতা শেখায় এবং অন্তরে ঈমানের সৌন্দর্য রোপণ করে।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, চেম্বার অপ কমার্স পর্তুগাল বাংলাদেশ এন্ড ইন্ডাস্ট্রি ( পিবিসিসিআই ) এবং সম্পাদক, ইউরো বাংলা।