১৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মতামত

নীতিহীনতা : মানবজীবনের অদৃশ্য পতন

নীতিহীনতা : মানবজীবনের অদৃশ্য পতন

আবদুল আহাদ সালমান


মানুষের জীবনে নীতি, আদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধ হলো দিকনির্দেশনার বাতিঘর। এই মূল্যবোধ মানুষকে পরিচালিত করে সঠিক পথে। সমাজে মানুষকে করে মর্যাদাবান। জীবনকে করে তোলে অর্থবহ ও স্বচ্ছ। কিন্তু যখন কেউ নীতিহীনতার পথে হাঁটতে শুরু করে, তখন তার জীবন হয়ে যায় কাঁটাবিহীন ঘড়ির মতো। তার কোনো দিশা থাকে না, গন্তব্য থাকে না, কার্যকারিতাও থাকে না।

আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচার, সৎকর্ম এবং আত্মীয়ের হক আদায় করতে আদেশ করেন। (সূরা নাহল ১৬:৯০)

এই আয়াতই স্পষ্ট করে যে নীতিহীনতা মানুষকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়, আর নীতি-ন্যায় মানুষকে উন্নত করে।

নীতিহীন মানুষ দ্বারা সমাজের কোনো উপকার হয় না :

যেভাবে কাঁটা-বিহীন ঘড়ি সময় জানাতে পারে না, ঠিক তেমনি নীতিহীন মানুষও সমাজে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। তার কাজ, আচরণ ও সিদ্ধান্ত অন্যদের জন্য কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করে না; বরং প্রায়শই বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (সহিহ মুসলিম ১০১)

হাদিসটি নীতিহীনতার সামাজিক ক্ষতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

নীতি না থাকলে মানুষের লক্ষ্যও স্থির থাকে না :

নীতিহীন মানুষের আচরণের ভিত্তি যেহেতু অনির্ভরযোগ্য, তাই সে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের অবস্থান বদলে ফেলে। যেমন কাঁটাবিহীন ঘড়ির সময় কখনোই নির্দিষ্ট নয়, তেমনি নীতিহীন মানুষের ওপর কেউ ভরসা করতে পারে না। এ কারণে সমাজে তার সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায়।

আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।(সূরা তাওবা ৯:১১৯)

সত্যবাদীদের সঙ্গী হতে হলে নীতির ওপর স্থির থাকতে হয়; নীতি না থাকলে সত্যবাদী হওয়া অসম্ভব।

ইমাম মালিক (রহ.) সুন্দর করে বলেছেন: সত্যের ওপর দৃঢ়তা চরিত্রকে স্থির করে, আর মিথ্যা ও নীতিহীনতা মানুষকে ধ্বংস করে।

নীতি-মানব চরিত্রের মূল স্তম্ভ :

নীতিহীন মানুষ সংকটের সময় নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়াতে পারে না। সে অন্যায়কে সমর্থন করে কিংবা স্বার্থের জন্য অন্যকে ক্ষতি করে। কিন্তু নীতিবান মানুষ দৃঢ়চিত্তে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়-যা তাকে সমাজে অনুকরণীয় করে তোলে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সত্য নেকির দিকে পথ দেখায়, আর নেকি জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।(বুখারি ৬০৯৪, মুসলিম ২৬০৭)

আরও বলেছেন, অন্যায় ও গুনাহ মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। অতএব, নীতিহীনতা শুধু নৈতিক দুর্বলতাই নয়, এটি মানুষের আত্মিক ধ্বংসের পথও তৈরি করে।

সামাজিক উন্নতির পূর্বশর্ত, নীতিনিষ্ঠ নাগরিক :

নৈতিকতার শক্তিতেই সমাজ উন্নত হয়। নীতিহীন মানুষের কারণে দুর্নীতি, প্রতারণা, অবিশ্বাস ও সামাজিক অবক্ষয় ছড়িয়ে পড়ে। তাই একজন নীতিহীন ব্যক্তি শুধু নিজের নয়, গোটা সমাজের জন্যই হুমকি।

হজরত উমর (রা.) বলেছেন, আমরা নৈতিকতার মাধ্যমে সম্মানিত হয়েছি; নৈতিকতা ত্যাগ করলে আমরা আবার অপমানিত হব। এই বাণী প্রমাণ করে-নীতি হারালে সমাজের সম্মানও হারিয়ে যায়।

মানুষের জীবনে নীতি হলো সেই দিকনির্দেশক কাঁটা, যা সঠিক পথ দেখায়। নীতি মানুষকে মহান করে, সমাজে শ্রদ্ধার আসনে বসায়। আর নীতিহীনতা মানুষকে দিকভ্রান্ত, মূল্যহীন ও অকার্যকর করে তোলে-যেমন কাঁটা-বিহীন ঘড়ি।

অতএব, আমাদের সকলেরই উচিত নীতি ও মূল্যবোধকে জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা। কারণ নীতিই জন্ম দেয় আস্থা, সম্মান, মহিমা ও উন্নতি। নীতির পথেই নির্মিত হয় ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির আলোয় ভরা ভবিষ্যৎ।

লেখক : প্রেসিডেন্ট, চেম্বার অব কমার্স পর্তুগাল বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (PBCCI); সম্পাদক, ইউরোবাংলা