১৪ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ইসলামি সংস্কৃতির সূচনা ও নববী যুগের সাংস্কৃতিক মঞ্চ

আবদুল আহাদ সালমান


ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা যা মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত করে। এর মধ্যে সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নববী যুগে ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ কেবল ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকেও এক যুগান্তকারী অধ্যায় রচনা করে। হিজরতের পর যখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় প্রবেশ করেন, তখন মদিনাবাসীরা আনন্দের সঙ্গে তাঁকে স্বাগত জানায়। সেই মুহূর্তেই ইসলামি সংস্কৃতির সূচনা ঘটে যা ইতিহাসে “ত্বালা আল বাদরু আলাইনা” গানের মাধ্যমে অমর হয়ে আছে।

ইসলামি গানের সূচনা:

মদীনার নারী ও শিশুদের কণ্ঠে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনে উচ্চারিত হয়েছিল ঐতিহাসিক গান

“ত্বালা আল বাদরু আলাইনা, মিন সানিয়্যাতিল ওয়াদা
ওয়াজাবাশ শুকরু আলাইনা, মা দা’আ লিল্লাহি দা”

যার অর্থ হচ্ছে, ওয়াদা পাহাড়ের দিক থেকে পূর্ণ চাঁদ আমাদের উপর উদিত হয়েছে; আল্লাহর পথে আহ্বান চলতে থাকা পর্যন্ত আমাদের কৃতজ্ঞতা অব্যাহত থাকবে।

ইমাম আল-বাইহাকি তাঁর “দালায়িলুন নুবুয়্যাহ” গ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। গবেষকরা এটিকে ইসলামি সংস্কৃতির প্রথম সংগীতধর্মী নিদর্শন বলে মনে করেন। এতে প্রকাশ পেয়েছে নবীপ্রেম, ঐক্য, আনন্দ ও ঈমানভিত্তিক সমাজ গঠনের চেতনা। এটি প্রমাণ করে যে, ইসলামে আনন্দ ও শিল্পের স্থান আছে, তবে তা সর্বদা নৈতিকতার সীমার মধ্যে।

নববী যুগের সাংস্কৃতিক মঞ্চ ও হাসসান ইবন সাবিত (রা.) :

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের শত্রুদের কবিতার জবাব দিতে সাহাবি হাসসান ইবন সাবিত (রা.)-কে উৎসাহিত করেন। তাঁর জন্য মসজিদে নববীতে একটি মঞ্চ (মিম্বার ) নির্মাণের নির্দেশ দেন।

সহিহ বুখারিতে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি (হাসসান) তাদের কবিতার জবাব দাও, আর জিবরাইল (আঃ) তোমাকে সহায়তা করবেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৩২১২)

এই মঞ্চই ইতিহাসের প্রথম ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে কবিতা ও সাহিত্যকে দাওয়াহর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হাসসান (রা.) কবিতা মুসলমানদের মনোবল জোগাত এবং ইসলামের মর্যাদা রক্ষায় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তুলত।

ইসলামি সংস্কৃতির দর্শন ও উদ্দেশ্য :

ইসলামি সংস্কৃতি কখনও শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়; বরং এটি শিক্ষণ, দাওয়াহ ও নৈতিক উন্নতির পথ।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই কিছু কবিতা প্রজ্ঞার সমান।(সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৬১৪৫)

অতএব, ইসলাম শিল্প ও সাহিত্যকে নিষিদ্ধ করেনি; বরং তাকে সত্য, কল্যাণ ও নৈতিকতার সেবায় নিয়োজিত করেছে। নববী যুগের সাংস্কৃতিক চর্চা আমাদের শেখায় সৃজনশীলতা তখনই মূল্যবান, যখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়।

অন্যান্য সাহাবিদের সাংস্কৃতিক অবদান :

১। কা‘ব ইবন মালিক (রা.)

তিনি ছিলেন মদীনার বিখ্যাত কবি। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর কবিতা ইসলামের প্রচার ও আত্মসমালোচনার ভাষা হয়ে ওঠে। তাবুক অভিযান শেষে তাঁর তওবা ও কবিতার মধ্যে ছিল গভীর নৈতিক বার্তা, যা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ‍ওয়া সাল্লাম স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

২। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা.)

তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও যোদ্ধা। নবী করিম (সা.) তাঁর কবিতার প্রশংসা করে বলেছিলেন, “তোমার কবিতা তাদের ওপর তীরের মতো।” তাঁর কবিতায় ঈমান ও জিহাদের অগ্নিশিখা জ্বলজ্বল করত। তিনি মুআতা যুদ্ধে শহীদ হন।

৩। আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.)

তিনি ছিলেন প্রখর বক্তা ও সাহিত্যপ্রেমী মহিলা সাহাবি। নবীর সামনে তিনি নারীদের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরতেন। তাঁকে বলা হয় “খাতীবাতুন নিসা” নারী বক্তাদের অগ্রদূত। তাঁর মাধ্যমে ইসলামি সংস্কৃতিতে নারীর সক্রিয় ভূমিকার সূচনা হয়।

৪। আবু হুরায়রা (রা.)

তিনি সরাসরি কবি না হলেও হাদীস, কাহিনি ও উপমার মাধ্যমে ইসলামের মৌখিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসসমূহ ইসলামি সংস্কৃতির নৈতিক ভিত্তি স্থাপন করেছে।

৫। আলী ইবন আবি তালিব (রা.)

তিনি ছিলেন জ্ঞানের, সাহিত্যের ও নন্দনতত্ত্বের প্রতীক। তাঁর বক্তৃতা ও প্রবাদসমূহ পরে নাহজুল বালাগাহ নামে সংকলিত হয়, যা ইসলামি বাগ্মিতা ও সাহিত্যিক ভাবধারার এক অনন্য নিদর্শন।

নববী যুগের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য :

নববী যুগের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। তখনকার সংস্কৃতি ছিল নৈতিক ও শিক্ষণীয়, অশ্লীল নয়। কবিতা, সংগীত, বক্তৃতা ও গল্পের মাধ্যমে সমাজে দাওয়াহ প্রচলিত ছিল। নারী ও পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। সংস্কৃতি ছিল ঈমান, ঐক্য ও মানবকল্যাণের প্রতীক।

এই সব উপাদান মিলেই নববী যুগের সংস্কৃতি মানব ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে নববী ঐতিহ্য :

বর্তমান যুগে ইসলামি সংগীত, নাশিদ, ইসলামি নাটক, কবিতা আবৃত্তি বা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা সবই নববী যুগের সেই মঞ্চের ধারাবাহিকতা। তবে এর উদ্দেশ্য হতে হবে নৈতিক, দাওয়াহমুখী ও শিক্ষণীয়। নববী ঐতিহ্যের অনুসরণই আজকের মুসলিম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাফল্যের চাবিকাঠি।

“ত্বালা‘আল বাদরু ‘আলাইনা” ছিল ইসলামি সংস্কৃতির প্রথম সংগীতধর্মী নিদর্শন, যা নববী যুগের আনন্দ, ঐক্য ও ঈমানের প্রতীক। মসজিদে নববীর সাংস্কৃতিক মঞ্চ প্রমাণ করে ইসলাম শিল্প ও সাহিত্যকে নিষিদ্ধ করেনি, বরং সঠিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত করেছে।

হাসসান ইবন সাবিত, কা‘ব ইবন মালিক, আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা, আসমা বিনতে ইয়াজিদ ও আলী (রা.) সবাই দেখিয়েছেন, সত্য, নৈতিকতা ও সৌন্দর্যের সংমিশ্রণই হলো প্রকৃত ইসলামি সংস্কৃতি।
আজ আমাদের প্রয়োজন সেই নববী আদর্শে গঠিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, যা দাওয়াহ, শিক্ষা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করবে।

ইসলামি সংস্কৃতি শুধু ইতিহাস নয় এটি এক চলমান আন্দোলন, যার শেকড় নববী যুগে প্রোথিত, আর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে আজও সমগ্র পৃথিবীতে।

লেখক : প্রেসিডেন্ট, পর্তুগাল বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (পিবিসিসিআই); সম্পাদক, ইউরো বাংলা ও প্রতিষ্ঠাতা প্রধান পরিচালক, জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন “অনুপ্রাস”