২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অবক্ষয়ের সংজ্ঞা

ব্যক্তি ভাল কাজ করল অথচ সমাজে তারিফ করার কেউ রইল না, মন্দ কাজ করল কেউ ধিক্কারধ্বনি তুলল না, বুঝতে হবে সমাজে তখন অবক্ষয় চলছে। মানুষের একাংশ মানুষ, আরেকাংশ পশু। সামাজিক মানুষের মানবিক সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যসমূহ পাশবিক অস্তিত্বের চাপে যখন থেতলে স্ফুরণের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ, যখন কেবল মানুষের পশু-অস্তিত্বের প্রতাপ প্রচণ্ড আস্ফালনে দশদিক মুখরিত করে তোলে, সেই সময়ে অবক্ষয় সমাজের ভেতরে রাজ্যপাট বিস্তার করতে থাকে।

মানুষ যখন ভাবনা-চিন্তা করে না, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে আনন্দে ঢেকুর তুলতে থাকে, অস্তিত্বের মর্মমূল থেকে জিজ্ঞাসার শাণিত ছুরি প্রাণশক্তির তাপে ঝিকিয়ে ওঠে না সেই চিন্তাহীন, স্বপ্নহীন, গতিহীন নিস্তরঙ্গ পরিবেশে অবক্ষয়ের কালো বাদুড় পাখা প্রসারিত করে থিতু হয়ে আসন রচনা করে। অতীত যখন গর্ভগুহা থেকে বেরিয়ে এসে আগামীর পথ রোধ করে দাঁড়ায়, মৃত্যু যখন জীবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে, সমাজের­ জড়শক্তির চাপে ব্যক্তিমানস যখন একেবারে উত্থানশক্তিহীন, মতপ্রকাশ করার বদলে যখন সকলে শুধু কথা বলতে থাকে, সেই ফলহীন বাক্যস্রোত থেকে অবক্ষয়ের জীবাণু কালো কালো বিন্দুর আকারে নির্গত হয়ে দৃশ্যমান নিখিলের চেহারা মসিকৃষ্ণ অন্ধকারে আবৃত্ত করে, তখন অবক্ষয় ব্যাধি সংক্রমণের প্রত্যক্ষ কারণস্বরূপ বিদ্যাবুদ্ধির বেপারিদের শনাক্ত করতে না পারলে অবক্ষয় দীর্ঘস্থায়ী হয়।

সমাজে ভাল মানুষেরা যখন অসহায়, ভাল মানুষের ভালত্ব যখন সমাজের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা গ্রহণ করতে অক্ষম, ইতর-মানুষেরা একে একে সম্মানের আসনে চড়ে মানবিক মূল্যবোধসমূহকে মুখ ভ্যাংচিয়ে ব্যঙ্গ করতে থাকে এবং তাদের কাছ থেকে সম্মান শিরোপা গ্রহণ করার জন্য পিপীলিকার মত পিলপিল করে সারস্বত সমাজের তথাকথিত পূজনীয় ব্যক্তিরা ছুটতে থাকেন, তখন বুঝতে হবে অবক্ষয়ের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।

একটি সমাজে যখন কোনকিছু সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক নয়; সবটাই নকল এবং ভঙ্গি-সর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়েছে, বুড়োরা চ্যাংড়ার মত আচরণ করে, যুবকেরা প্রৌঢ়ত্বের ভান করে, শিশু-কিশোরেরা এঁচড়ে পেকে যায়, ধীমান পাঠক ইত্যাকার লক্ষণ বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, ওই সমাজে ঝাঁক ঝাঁক পঙ্গপালের মত অবক্ষয় নখ-দাঁত মেলে আক্রমণ ছুটে আসছে।। পথ কংক্রিট দিয়ে বন্ধমেরে আক্রমণমতোর নেশায় মিছিল করে বেড়ায়, প্রিয় ভ্রাতা ধর্ম যখন মঙ্গল কল্যাণের পথ কংক্রিট দিয়ে বন্ধ করে শক্তিমদনত্ততার নেশায় মিছিল করে বেড়ায়, প্রিয় ভ্রাতা
ও ভগিনীগণ মনে করে নেবেন, অবক্ষয় মূর্তিমান রূপ পরিগ্রহ করে চোখের সামনে রাজপথে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। যেসব মানুষ জীবনে কোনদিন বিজ্ঞান গবেষণা কি বস্তু চোখে দেখেনি সেই মানুষেরা বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে তাঁদের কৃত প্রিয় অপকর্মসমূহের মাহাত্ম্য যখন প্রচার করে, গৌড়জন বুঝে নেবেন, শয়তানের মত ওই ভদ্রসন্তানদের মস্তকে অবক্ষয় সওয়ার হয়ে বসে আছে। লেখক-সাহিত্যিকেরা যখন শুধু কথা বানানোর প্রচেষ্টায় নিজেদের আটপ্রহর মশগুল রাখে, কল্যাণ-সুন্দরের দিকে পিঠ দিয়ে লম্বা-চওড়া বাক্য নির্মাণ করে যায় স্বভাবের তাগিদে, আপনারা সকলে বুঝে নেবেন, অবক্ষয়-আক্রান্ত সমাজের লেখক-সাহিত্যিকেরা এরকমই হয়ে থাকে। তাঁরা মেরুদণ্ডের ওপর ভর করে দাঁড়ানোর চাইতে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে অধিক আনন্দিত বোধ করেন।

পরিবেশ দূষণ এবং আরো নানা নৈসর্গিক কারণে আমাদের দেশে বিশেষ বিশেষ প্রজাতির বিষাক্ত সাপ এবং লোভী শকুনের বংশ ধ্বংস হতে চলেছে, সেই বিলুপ্তপ্রায় হিংস্র ও লোভী প্রাণীদের স্বভাব যখন দেখতে পাবেন সমাজের মানুষের একাংশের মধ্যে অত্যন্ত দ্রুত বিকাশ লাভ করতে আরম্ভ করেছে, সেই সময়টাকে অবক্ষয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ বলে মেনে নিলে বঙ্গীয় পাঠক সম্প্রদায় অনেক সংশয় থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।

ওপরের যে সকল সংজ্ঞা বয়ান করলাম সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে চালু রয়েছে। যেহেতু বিজ্ঞান একটি সতত বিকাশমান প্রক্রিয়া, তাই অবক্ষয়- বিজ্ঞানেও কতিপয় নতুন সংজ্ঞা হালফিল কামেল ব্যক্তিরা অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ধারণা করি, অদূর ভবিষ্যতে সেগুলোও সার্বজনীন সংজ্ঞা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেবে। বিশেষজ্ঞের সুপারিশকৃত কতিপয় সংজ্ঞার মধ্যে এখানে শুধু একটির কথাই উল্লেখ করব। কেননা অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্বজ্জনেরা ওটিকে একরকম স্বীকৃতি দিয়েই ফেলেছেন। আর সংজ্ঞাটিও এরকম, দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষেরা কলা চুরি, মুলোচুরিকে প্রায় উপলক্ষ করেও যখন সংবাদপত্রে বিবৃতি দিতে থাকবেন, প্রধান না হলেও অবক্ষয়ী সমাজের একটি গৌণ লক্ষণ হিসেবে এটিকে মেনে নিতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।

সংগ্রহ: আহমদ ছফা রচনাবলি- ৩