আয় ও জিডিপি দিয়ে কোনো দেশের উন্নতির প্রকৃত চিত্র পুরোপুরি আঁকা যায় না। অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা দীর্ঘদিন ধরেই বলছেন, উন্নয়ন শুধু আয়ের অঙ্কে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মানুষের বহুমুখী কল্যাণের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এ কারণেই উন্নয়নের মাপকাঠি নিয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন নতুন ভাবনার জন্ম হয়েছে। আলোচনায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ‘সক্ষমতা পদ্ধতি’ এবং ভুটানের ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ)’। এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নের সংজ্ঞাকে শুধু বিস্তৃতই করেনি, বরং মানবকল্যাণকে উন্নয়নের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কর্মের আলোকে ‘ব্যক্তির জীবনকুশলতা ও সামাজিক কল্যাণ’ শীর্ষক পাঠচক্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। পাঠচক্রটি আয়োজন করেছে বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালার সভাপতি আহমেদ জাভেদ। প্রধান অতিথি ছিলেন অমর্ত্য সেন।সভাপতিত্ব করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। ভাচ্যুয়াল মাধ্যমে গতকাল শনিবার রাতে এই অনুষ্ঠান হয়।
আল-কায়ের উল্লেখ করেন, এই দৃষ্টিভঙ্গিই ২০০৯ সালের স্টিগলিটস-সেন-ফিতুসি কমিশন থেকে শুরু করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও ওইসিডির বিয়ন্ড জিডিপি উদ্যোগ পর্যন্ত বিভিন্ন নীতি বিতর্কে প্রভাব ফেলেছে।
ভুটানের গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস সূচককেও উদাহরণ হিসেবে সামনে আনেন আল-কায়ের। তাঁর ভাষায়, ভুটানের জিএনএইচ ভিন্ন হলেও দৃষ্টিভঙ্গি একইভাবে বহুমাত্রিক। উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যবোধ, বহুমুখী নীতি আর জিডিপি বৃদ্ধির গণ্ডি ছাড়িয়ে কল্যাণ পরিমাপের আহ্বান করা হয়েছে।
এ ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশে যে জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক’ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, তার প্রশংসা করেন আল-কায়ের।
অমর্ত্য সেনের উপস্থিতি
আল-কায়েরের বক্তব্য চলাকালে হঠাৎ সঞ্চালক জানান, প্রধান অতিথি হিসেবে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এই নোবেলজয়ী সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, কেন ‘সক্ষমতা পদ্ধতি’ তৈরি করা হয়েছিল।
অমর্ত্য সেন বলেন, ‘এটি এসেছিল দুটি সীমাবদ্ধতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে: একদিকে কেবল আয় ও সম্পদের প্রতি একচেটিয়া মনোযোগ, অন্যদিকে কেবল ব্যক্তিগত সুখের দিকে দৃষ্টি। দুটিই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কোনোটিই যথেষ্ট নয়।’
অমর্ত্য সেন আরও যোগ করেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমাদের যা চাই, তা হলো নিজেদের মূল্যবান বলে মনে করার মতো জীবনযাপনের স্বাধীনতা।’
সুখকে উন্নয়নের চূড়ান্ত লক্ষ্য বানানোর ব্যাপারে সতর্ক করেন অমর্ত্য সেন। বলেন, সুখ অবশ্যই উপযোগী সূচক হতে পারে, কিন্তু মূল বিষয় হলো মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত জীবনযাপনের সক্ষমতা রাখছে কি না। বয়স ও স্বাস্থ্যের কারণে তিনি বেশি সময় থাকতে পারেননি।
উপস্থাপনা দেন সাবিনা আল–কায়ের
আলোচনায় ফিরে আল-কায়ের বিশদভাবে ভুটানের জিএনএইচ সূচকের ব্যাখ্যা দেন। দীর্ঘদিন এটি ছিল কেবল আকাঙ্ক্ষার বিষয়। তবে ২০০০-এর দশকে ভুটান এটিকে বাস্তব সূচকে রূপ দিতে শুরু করে এবং ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিক সূচক চূড়ান্ত করে।
এ সূচক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, পরিবেশগত সহনশীলতা, সামাজিক প্রাণশক্তিসহ নয়টি ক্ষেত্রকে যুক্ত করে প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে বসবাসের স্থান, লিঙ্গ, পেশা, বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হয়। এখানে কেবল ‘সুখী’ বা ‘অসুখী’ দুই ভাগে ফেলার পরিবর্তে প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয়। মোটামুটি দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ণ হলে তাকে যথেষ্ট ধরা হয়।
আল-কায়েরের মন্তব্য, জিএনএইচ সূচক সাংস্কৃতিকভাবে নির্দিষ্ট। কিন্তু অসম্পূর্ণ পরীক্ষা থেকেও মূল্যবান শিক্ষা লাভ করা সম্ভব। বিশেষ করে পর্যাপ্ততার ধারণা, বৈচিত্র্যের গুরুত্ব ও ব্যক্তিস্তরের বিশ্লেষণের কারণে এই শিক্ষা লাভ করা যায়।
দারিদ্র্য বহুমুখী
অধিবেশনের শেষ বক্তব্য দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, দারিদ্র্য কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি গভীরভাবে বহুমাত্রিক অবস্থা। কেবল আয় বা জিডিপিনির্ভর সূচকে ভরসা করা যায় না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, কর্মসংস্থান, ন্যায়বিচার প্রাপ্তি, সামাজিক অংশগ্রহণ—সব ক্ষেত্রেই বঞ্চনা বোঝা জরুরি।
রেহমান সোবহান জোর দিয়ে বলেন, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক মাত্রাকে গবেষণায় বিবেচনা করা না হলে দারিদ্র্য নিরসনের কৌশল ভঙ্গুর থেকে যায়। তিনি সংস্কৃতিকেও ‘মর্যাদা, পরিচয় ও সামাজিক সংহতির অপরিহার্য উপাদান’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
অধ্যাপক আলকায়ের আহ্বানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ক্ষমতায়িত করার গুরুত্বও তুলে ধরেন। তাঁর ভাষায়, অঙ্গীকারবদ্ধ তরুণেরা, এমনকি সাধারণ অবস্থান থেকেও, বড় পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটাতে পারেন। নেতৃত্ব তৃণমূল পর্যায় থেকেও উঠে আসে।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে আল-কায়ের ‘নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রকল্প’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। বলেন, ‘যদি আমরা দারিদ্র্যকে প্রকৃত অর্থে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই, তাহলে আমাদের নীতি, গবেষণা ও আন্দোলনেও সেই বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটাতে হবে।’
মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, অর্থনৈতিক গবেষণায় আইনকে কাঠামোগত উপাদান হিসেবে নিতে হবে। তাঁর মতে, আইনি বিষয়গুলো অর্থনৈতিক সম্পর্কের গবেষণায় একীভূত হলে তা সমাজের জন্য আরও ফলপ্রসূ হবে এবং মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহীদুল মামুন উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংস্কৃতিচর্চার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ অনেক সময় ব্যক্তিগত পছন্দ বলে মনে করা হয়। কিন্তু আজকের আলোচনায় দেখা গেছে, বিষয়টি কেবল ব্যক্তির পছন্দের ওপর নির্ভর করে না, এসব কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার বিষয়টিও কল্যাণের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ মানুষ কেমন আছে, তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের যোগ আছে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান। বক্তব্য দেন ভারতীয় লেখক স্বাতী নারায়ণ, পপুলেশন কাউন্সিল নিউইয়র্কের জ্যেষ্ঠ গবেষক সাজেদা আমীন। এ পাঠচক্রের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন পাঠচক্রের আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক প্রশান্ত কুমার পট্টনায়ক (ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড)। দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এবং মিডল্যান্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
দারিদ্র্য হ্রাস
তরুণেরা বাস্তবে দারিদ্র্য মোকাবেলায় কী করতে পারেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আল-কায়ের বলেন, পরিবর্তন সব সময় শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু হয় না। অনেক সময় তা আসে অঙ্গীকারবদ্ধ ব্যক্তিদের হাত ধরে। তাঁর পরামর্শ ছিল এ রকম, ‘আপনি যা নিয়ে ভাবেন, তা নিয়েই কাজ শুরু করুন, নিজের অবস্থানে দৃঢ় থাকুন, ছোট উদ্যোগও বড় হতে পারে; সমাজের নেতা ও প্রতিষ্ঠানের ওপরও তার প্রভাব পড়তে পারে।’
এই পাঠকচক্রে বিশ্বের ১৬টি দেশের নাগরিকেরা অংশ নিচ্ছেন। ১৩ সেপ্টেম্বর পাঠচক্রের মূল পর্ব শুরু হবে।