১৪ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মতানৈক্য, ঐক্য ও সফলতা

আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্


পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, মহৎ ও মসৃণভাবে গড়ে উঠেছে—তার পেছনে সবসময় কিছু নির্মল ও উদারচিত্ত মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস লুকিয়ে থাকে। তাদের সুস্পষ্ট লক্ষ্য, স্থির মনোযোগ এবং একান্ত প্রচেষ্টার ফসল হিসেবেই সফলতার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে যুগে যুগে।

যে কোনো সফলতার অন্তরালের গল্প গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই—প্রাথমিক ঐক্যের পর থেকে চূড়ান্ত সফলতা পর্যন্ত পৌঁছাতে নানা রকম পার্থক্যের আবির্ভাব ঘটে। চিন্তাধারায় ভিন্নতা, কর্মপরিকল্পনায় অমিল, কাজের গতি-উদ্দীপনায় অসামঞ্জস্য কিংবা সফলতার কৃতিত্ব নেওয়ার প্রবণতা—সবকিছুই কখনো কখনো মতপার্থক্যের জন্ম দেয়। এমনকি অনেক সময় নিজের অবস্থানকে অন্যদের সামনে দৃশ্যমান করার আকাঙ্ক্ষা কিংবা নির্লিপ্ত থাকার প্রবণতাও বিভেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই মতপার্থক্যের ফলে কেউ কেউ দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, আবার কেউ স্বেচ্ছায় দূরে সরে যান। তবে এ কোনো নতুন দৃশ্য নয়—মানবসভ্যতার প্রতিটি যুগেই প্রতিটি দলে এরকম মতভেদ দেখা গেছে। আবার সময়ের সাথে দূরত্ব ঘুচে গিয়ে ভাঙা ঐক্য পুনরুদ্ধারের নজিরও ইতিহাসে কম নেই।

তাই দেখা যায়, ঐক্যবদ্ধ শক্তি সংখ্যায় ক্ষুদ্র হলেও তাদের লক্ষ্য অর্জনে সময় বেশি লাগে না। সংকল্পে দৃঢ়, দৃষ্টিতে স্বচ্ছ, আর প্রচেষ্টায় একনিষ্ঠ দলই শেষ পর্যন্ত সফলতার আসন দখল করে।

আমার আজকের আলোচনার বিষয়—মতানৈক্য, ঐক্য ও সফলতা

মতানৈক্য –
মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক সম্প্রীতি, ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট নির্দেশ। যেমন রাসূলুল্লাহ সাঃ এর আগমন ঘটেছিল বিভক্ত ও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মানবসমাজকে এক সুতোয় গাঁথতে, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে।

ইসলামের দাওয়াত ও বিধান কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নয়, বরং উম্মাহর ঐক্য সংরক্ষণ এবং বিভেদ ও অনৈক্য থেকে বিরত রাখার মহান নির্দেশ।  এটি কোনো সাধারণ বিষয় নয়—বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ আমরা এমন বাস্তবতার সম্মুখীন যে, মুসলিম উম্মাহ ছোট্ট ছোট্ট বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ বিভক্তি। পৃথিবীর একচতুর্থাংশ মানুষ মুসলমান হলেও দ্বীন মানার ক্ষেত্রে সুন্নি, শিয়া,খারিজি ও আহমদিয়া নামে বিভক্ত, আবার সুন্নীদের মধ্যে রয়েছে মাযহাব, মসলক বিভক্তি। যেমন, হানাফি,শাফিঈ,মালিকি ও হাম্বলি। তবে আমার আলোচনার বিষয় ইসলামী সংগঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রস্তাবনা, আলোচনা, পর্যালোচনা, মত প্রকাশ, মতের সেক্রিফাইস, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন বিষয়ে।

ঐক্যের গুরুত্ব ও অনৈক্যর শাস্তি –
ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে জনশক্তির সংগঠিত হওয়ার মূল ভিত্তি হলো ঈমান।
ঈমানের প্রাণশক্তি নিহিত রয়েছে তাওহীদের আলোকে একটি কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংকল্পে। যে সমাজ ন্যায়, সত্য ও সুশাসনের উপর দাঁড়িয়ে মানবতার মুক্তির বার্তা বহন করবে।
এ মহৎ দায়িত্বে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য আল্লাহর কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয়। বরং তিনি বারবার তাঁর কিতাবে মুমিনদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে ঐক্যের গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।

তার মধ্য থেকে কয়েকটি আয়াত নিম্নে উল্লেখ করছি—
সূরা মুমিনুন এর ৫২-৫৩ আয়াতে আল্লাহ বলেন –

وَ اِنَّ هٰذِهٖۤ اُمَّتُكُمْ اُمَّةً وَّاحِدَةً وَّ اَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُوْنِ-
فَتَقَطَّعُوْۤا اَمْرَهُمْ بَیْنَهُمْ زُبُرًا١ؕ كُلُّ حِزْبٍۭ بِمَا لَدَیْهِمْ فَرِحُوْنَ-

আর তোমাদের এ উম্মত হচ্ছে একই উম্মত এবং আমি তোমাদের রব, কাজেই আমাকেই তোমরা ভয় করো।
কিন্তু পরে লোকেরা নিজেদের দ্বীনকে পরস্পরের মধ্যে টুকরো করে নিয়েছে। প্রত্যেক দলের কাছে যা কিছু আছে তার মধ্যেই নিমগ্ন হয়ে গেছে।

সূরাতুল আম্বিয়ার ৯২-৯৩ আয়াতে

اِنَّ هٰذِهٖۤ اُمَّتُكُمْ اُمَّةً وَّاحِدَةً١ۖ٘ وَّ اَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوْنِ-
وَ تَقَطَّعُوْۤا اَمْرَهُمْ بَیْنَهُمْ١ؕ كُلٌّ اِلَیْنَا رٰجِعُوْنَ۠

তোমাদের এ উম্মত আসলে একই উম্মত। আর আমি তোমাদের রব। কাজেই তোমরা আমার ইবাদাত করো।
কিন্তু (নিজেদের কার্যকলাপের মাধ্যমে) লোকেরা পরস্পরের মধ্যে নিজেদের দ্বীনকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। সবাইকে আমার দিকে ফিরে আসতে হবে।

সুরা আশ-শূরা, আয়াত: (১৩- ১৫)

شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّیْنِ مَا وَصّٰى بِهٖ نُوْحًا وَّ الَّذِیْۤ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْكَ وَ مَا وَصَّیْنَا بِهٖۤ اِبْرٰهِیْمَ وَ مُوْسٰى وَ عِیْسٰۤى اَنْ اَقِیْمُوا الدِّیْنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوْا فِیْهِ١ؕ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِیْنَ مَا تَدْعُوْهُمْ اِلَیْهِ١ؕ اَللّٰهُ یَجْتَبِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یَّشَآءُ وَ یَهْدِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یُّنِیْبُ-
وَ مَا تَفَرَّقُوْۤا اِلَّا مِنْۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْیًۢا بَیْنَهُمْ١ؕ وَ لَوْ لَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَّبِّكَ اِلٰۤى اَجَلٍ مُّسَمًّى لَّقُضِیَ بَیْنَهُمْ١ؕ وَ اِنَّ الَّذِیْنَ اُوْرِثُوا الْكِتٰبَ مِنْۢ بَعْدِهِمْ لَفِیْ شَكٍّ مِّنْهُ مُرِیْبٍ-
فَلِذٰلِكَ فَادْعُ١ۚ وَ اسْتَقِمْ كَمَاۤ اُمِرْتَ١ۚ وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ١ۚ وَ قُلْ اٰمَنْتُ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ مِنْ كِتٰبٍ١ۚ وَ اُمِرْتُ لِاَعْدِلَ بَیْنَكُمْ١ؕ اَللّٰهُ رَبُّنَا وَ رَبُّكُمْ١ؕ لَنَاۤ اَعْمَالُنَا وَ لَكُمْ اَعْمَالُكُمْ١ؕ لَا حُجَّةَ بَیْنَنَا وَ بَیْنَكُمْ١ؕ اَللّٰهُ یَجْمَعُ بَیْنَنَا١ۚ وَ اِلَیْهِ الْمَصِیْرُؕ

তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) যা এখন আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম আমি ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) ও ঈসাকে (আ) । তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, এ দ্বীনকে কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে পরস্পর ভিন্ন হয়ো না। (হে মুহাম্মাদ) এই কথাটিই এসব মুশরিকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় যার দিকে তুমি তাদের আহবান জানাচ্ছো। আল্লাহ‌ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং তিনি তাদেরকেই নিজের কাছে আসার পথ দেখান যারা তাঁর প্রতি রুজু করে।

মানুষের কাছে যখন জ্ঞান এসে গিয়েছিল তারপরই তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে। আর তা হওয়ার কারণ তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছিলো। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মূলতবী রাখা হবে একথা যদি তোমার রব পূর্বেই ঘোষণা না করতেন তাহলে তাদের বিবাদের চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়া হতো। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ববর্তীদের পরে যাদের কিতাবের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে তারা সে ব্যাপারে বড় অস্বস্তিকর সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে।

যেহেতু এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাই হে মুহাম্মাদ এখন তুমি সেই দ্বীনের দিকেই আহবান জানাও এবং যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছো সেভাবে দৃঢ়তার সাথে তা আঁকড়ে ধরো এবং এসব লোকের ইচ্ছা আকাংখার অনুসরণ করো না। এদের বলে দাও, “আল্লাহ‌ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তার ওপর ঈমান এনেছি। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তোমাদের মধ্যে ইনসাফ করি। আল্লাহই আমাদেরও রব এবং তোমাদেরও রব তিনিই। আমাদের কাজকর্ম আমাদের জন্য আর তোমাদের কাজকর্ম তোমাদের জন্য। আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোন বিবাদ নেই। একদিন আল্লাহ‌ আমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। তাঁর কাছেই সবাইকে যেতে হবে।

ইসলামের যে সকল বিধান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, কিংবা যে সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সমাধান করে গিয়েছেন—এসব বিষয়ে দ্বিমত করা কোনোভাবেই ঈমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের মতো মৌলিক আকীদার ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকলে নিঃসন্দেহে তার ঈমানের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠবে। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে যদি মতপার্থক্য দেখা দেয়, তবে তা ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য, এবং ঐক্যমতের পথেই পৌঁছানো সম্ভব। আসলে শরীয়তের বিধান পালন নিয়ে অতীতেও ভিন্নমত ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। কেননা, ইসলামে এ মতপার্থক্যের মধ্যেই রয়েছে এক অনন্য সৌন্দর্য ও প্রজ্ঞা।

ঈমান ও আকীদা অটুট রেখে যখন কোন সংগঠন বা জামায়াত- কল্যাণমুখী ইসলামী সমাজ গড়তে কাজ শুরু করেন, তখন তাদের সম্মিলিত যাত্রায় মতপার্থক্য এক অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা অনেক সময় মতভেদকারীদের সাথে শিষ্টাচার হারিয়ে কঠোর আচরণ করি। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন—মতপার্থক্যের কারণে কারো প্রতি জুলুম করতে নেই।
আমরা সুরা আল ইমরানের (১০৩-১০৭)

وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟ ۚ وَٱذْكُرُوا۟ نِعْمَتَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَآءًۭ فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِۦٓ إِخْوَٰنًۭا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍۢ مِّنَ ٱلنَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمْ ءَايَـٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ –
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌۭ يَدْعُونَ إِلَى ٱلْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِٱلْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ ٱلْمُنكَرِ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ –
وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُوا۟ وَٱخْتَلَفُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَـٰتُ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ –

يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌۭ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌۭ ۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ٱسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَـٰنِكُمْ فَذُوقُوا۟ ٱلْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ –

وَأَمَّا ٱلَّذِينَ ٱبْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِى رَحْمَةِ ٱللَّهِ هُمْ فِيهَا خَـٰلِدُونَ –

আল্লাহর রজ্জুকে সমবেতভাবে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর নি‘মাত স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু, তিনি তোমাদের অন্তরে প্রীতির সঞ্চার করলেন, ফলে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নি-গহ্বরের প্রান্তে ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে তাত্থেকে রক্ষা করলেন। এভাবে আল্লাহ নিজের নিদর্শনাবলী তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা সঠিক পথ প্রাপ্ত হও।

তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল হোক, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করে, সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ করে আর এরাই সফলকাম।

তোমরা সেই লোকদের মত হয়ে যেয়ো না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন পৌঁছার পরে বিভক্ত হয়েছে ও মতভেদ করেছে এবং এ শ্রেণীর লোকেদের জন্য আছে মহা শাস্তি।

সে দিন কতক মুখ উজ্জ্বল হবে আর কতক মুখ কালো হবে, যাদের মুখ কালো হবে, (তাদেরকে বলা হবে), তোমরা কি ঈমান আনার পরও কুফরী করেছিলে? কাজেই নিজেদের কুফরীর জন্য শাস্তি ভোগ করতে থাক।

যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা আল্লাহর রহমতের মধ্যে থাকবে, তারা তাতে চিরকাল থাকবে।

ইসলামের মহিমা ও সৌন্দর্যের অন্যতম রূপ হলো ঐক্যবদ্ধতা। আল্লাহর নির্দেশ পালনে পরস্পর মিলেমিশে প্রচেষ্টা চালানোই প্রকৃত ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিচয়। এর বাইরে অন্য কোনো চিন্তা বা ভিন্নপথের অবকাশ নেই। তবে আল্লাহর হুকুম পালনে সর্বোত্তম পথ অবলম্বনের জন্য মতামত, পরামর্শ, এমনকি দ্বিমতও আসতে পারে। এগুলো স্বাভাবিক। কিন্তু চূড়ান্তভাবে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, সেটি বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করা এবং আন্তরিক অনুগত্য প্রকাশ করা প্রত্যেকের কর্তব্য।

সিদ্ধান্তের পরও যদি কেউ অন্তরে মতানৈক্য লালন করে রাখে, তবে তা পরিণত হয় মারাত্মক ফিতনায়। রাসুলুল্লাহ সাঃ শেষ জামানার লোকদের ব্যাপারে বলতে গিয়ে বলেছেন :-

قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم   بَادِرُوا بِالأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا أَوْ يُمْسِي مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আধার রাতের মতো ফিতনা আসার পূর্বেই তোমরা সৎ আমলের দিকে ধাবিত হও। সে সময় সকালে একজন মু’মিন হলে বিকালে কাফির হয়ে যাবে। বিকেলে মু’মিন হলে সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে সে তার দীন বিক্রি করে বসবে। (মুসলিম ১১৮)

মতানৈক্যের ক্ষতিকর দিকসমূহ
১.মতভেদ ও মতানৈক্য সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে ঈমান দুর্বল হয়ে যায়, হৃদয়ে অবক্ষয় নেমে আসে। ভ্রাতৃপ্রেম আর সৌহার্দ্যের পরিবর্তে মুসলিম সমাজে অশান্তি ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়। এর ফলে শত্রুরা আমাদের দুর্বলতা অনায়াসে উপলব্ধি করে এবং তা কাজে লাগায়।

২.ইজমার মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্ত স্থির হওয়ার পরও যদি কেউ নিজস্ব মতকে প্রাধান্য দিতে থাকে, তবে সে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। শয়তানের প্ররোচনায় নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য লোক জড়ো করার চেষ্টা করে, আর এর মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশে ফিতনা ও ফাসাদের জন্ম দেয়।

৩.মতানৈক্য ও ফিতনা থেকে হিংসা, বিদ্বেষ ও পারস্পরিক শত্রুতা জন্ম নেয়। এর সুযোগে জাতশত্রুরা মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে সফল হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অভ্যন্তরীণ বিভাজনই বহুবার মুসলমানদের পরাজয়ের পথ সুগম করেছে।

৪.মতানৈক্যে লিপ্ত ব্যক্তি নিজের সৎ আমল থেকে বঞ্চিত হয়। সে সর্বক্ষণ অন্যকে পরাস্ত করার চিন্তায় নিমগ্ন থাকে, অকারণে বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং কলহ ও বিভাজনের গভীরে নিমজ্জিত হয়।

রাসূল সা: সতর্ক করে বলেছেন—
তোমরা বিভেদে জড়িও না; কারণ যারা তোমাদের পূর্বে বিভেদে জড়িয়েছে, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে।

অতএব স্পষ্ট যে, মতানৈক্য ধ্বংসের পথ আর ঐক্যই মুক্তির পথ।

চলবে—-


লেখক, সভাপতি : পর্তুগাল মুসলিম কমিউনিটি ( CRCIPT)