১৪ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মতানক্যৈ, ঐক্য ও সফলতা

আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্


(গত সংখ্যার পর)

মতানৈক্যের কমন কিছু কারণ :
ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের পথে ঐক্যবদ্ধ জানবাজ কর্মীদের মধ্যেও কখনো কখনো মতপার্থক্য উদ্ভব হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
এটি শুধু আজকের বাস্তবতা নয়—রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর যুগেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। তবে সে সময়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে পথ নির্দেশ করেছেন এবং রাসূল সাঃ সেই আলোকে সমাধান করেছেন।

বর্তমান যুগেও যখন কোনো মতবিরোধ দেখা দেয়, তখন কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাধান করা অপরিহার্য। কিন্তু অনেক সময় কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সমাধান স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও, ব্যক্তিগত মতের অমিল ও মানসিক সংকীর্ণতার কারণে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মতানৈক্যের কিছু সাধারণ কারণ প্রায়ই সামনে আসে, যেমন—

(ক) আদর্শের সুস্পষ্ট জ্ঞানের অভাব ও সংকীর্ণমনতা
(খ) আমিত্ব
(গ) নেতৃত্ব ও খ্যাতির প্রতিযোগিতা
(ঘ)স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সংগঠনে সম্পৃক্ত হওয়া
(ঙ)অপরের মত গ্রহণে অনীহা
(চ)আবেগপ্রবণতা
(ছ) সবর করতে না পারা

আদর্শের সুস্পষ্ট জ্ঞানের অভাব ও সংকীর্ণমনতা:
প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধি।  আর একজন প্রতিনিধি তার মালিকের গোলামী করবে এবং মালিকের দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করবে। যেই সমাজের প্রতিটি মানুষ ন্যায়-ইনসাফ থেকে বন্ঞ্চিত হবে না। যেখান মুসলিম-অমুসলিম সবাই বসবাস করবে কিন্তু জোর জবরদস্তি ও জুলুম থাকবেনা। এমন সমাজ পরিচালনার সকল রুপরেখা পবিত্র কুরআনে রয়েছে এবং রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ইসলামী সমাজ পরিচালনার দৃষ্টান্ত রয়েছে। সেই রকম সোনালী সমাজ বিনির্মানের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রতিটি কর্মীকে আদর্শের সুস্পষ্ট জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। যেমন :-

১.আল্লাহর একত্ববাদ , রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত ও আসমা-ও-সিফাতের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখা এবং
শিরক, বিদআত ও কুফর থেকে মুক্ত থাকা।

২. কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক জ্ঞান বিশেষ করে,
ঈমান, ইবাদত, ন্যায়বিচার, সমাজ সংস্কার।
ইসলামী জীবনধারা, শাসননীতি, দাওয়াতি পদ্ধতির সঠিক ব্যাখ্যা।

৩. শরীয়াহর জ্ঞান : সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্ব সম্পর্কে সহীহ ধারণা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উত্তরাধিকার, পরিবার ও সমাজজীবন নিয়ে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সচেতন হওয়া।

৪.আন্দোলনের রূপরেখা ও রণকৌশলের মূল উৎস হচ্ছে
রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সিরাত। তাই রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মক্কী ও মাদানী দাওয়াতি ধাপ, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রাম, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা রাখা।

৫. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা মানব সমাজের প্রতিটি জায়গায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করবে। সেজন্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক, কুটনৈতিক ও সামরিক সকল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা।

এ সকল বিষয়গুলো নিয়ে যাদের যত কম জ্ঞান তাদের ততবেশী বিরোধিতা মতানৈক্য থাকে। আর
যখন আন্দোলনের কর্মীরা এই সকল বিষয়ে সুস্পষ্ট, পূর্ণাঙ্গ ও শুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করবে, তখন মতবিরোধ কমে যাবে, ঐক্যের বন্ধন হবে আরও দৃঢ়, আর আন্দোলন অগ্রসর হবে সঠিক পথে—আদর্শ সমাজ গঠনের পথে।

সংকীর্ণমনতা:  আন্দোলনের অগ্রগতি, দায়িত্বশীলদের সহনশীলতা ও মানবিকতার পথে আরেকটি বাধা হলো সংকীর্ণমনতা। এটা এক ধরনের মানষিক রোগ।

আমিত্ব :
অনেক সময় দায়িত্বশীল ব্যক্তির কঠোর মনোভাব ও নিজের প্রস্তাব এবং মতামতকে অধস্তনদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কারনেও মতানৈক্য তৈরী হয়। দায়িত্ব শীল অন্যের মতামতকে গ্রহণ না করে আমিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। যেখানে এমন পরিবেশ তৈরী হয় সেখানে ধীরে ধীরে সাংগঠনিক ব্যাবস্থা ভেঙে পড়ে। ইসলামী আন্দোলনে আমিত্ব র স্থান নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّٰهِ لِنْتَ لَهُمْ١ۚ وَ لَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِیْظَ الْقَلْبِ لَا نْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ١۪ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَ اسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَ شَاوِرْهُمْ فِی الْاَمْرِ١ۚ فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّٰهِ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِیْنَ

(হে নবী!) এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে, তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল। নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে যেতো। তাদের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করো এবং দ্বীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করো। তারপর যখন কোন মতের ভিত্তিতে তোমার স্থির সংকল্প হবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো। আল্লাহ‌ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর ভরসা করে কাজ করে। (৩:১৫৯)

নেতৃত্বের আসনে থেকে আমিই সব এমন আচরণ পরিহার করে আমরা সবাই মিলে পরামর্শ করে কাজ করবো এমন মনোভাব থাকা আবশ্যক। কারন
দায়িত্বশীল ব্যক্তি অহংকারী হলে তা শুধু সংগঠন বা জনশক্তিকে দুরে ঠেলে দেয় তানয়, বরং নিজের  আখিরাতকেও ধ্বংস করে। রাসূলুল্লাহ (সা:)বলেছেন,
“যার অন্তরে সরিষা দানার সমান অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৯১)

রাসূল (সা:) আরো বলেছেন,
তোমরা একে অপরের প্রতি হিংসা করো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না, বরং আল্লাহর বান্দা হয়ে ভাই ভাই হয়ে থাকো। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

ইসলামী আন্দোলন আমিত্বের নয় ইসলামী আন্দোলন হচ্ছে ভ্রাতৃত্বের। যেখানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যত মজবুত সেখানে আন্দোলন তত শক্তিশালী।

নেতৃত্ব ও খ্যাতির প্রতিযোগিতা
ইসলামী সংগঠনে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা নেই। সবাই  দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে। কাজের মধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়। তারপরও মাঝে মাঝে
আন্দোলনের ভিতর নেতৃত্বের লালসা ও খ্যাতির প্রতিযোগিতার মত মারাত্মক রোগ কিছু লোককে পেয়ে যায়। এমন রোগে আক্রান্ত মানুষ মনে করে আমি বড়, আমি যোগ্য, আমার নেতা হওয়া উচিত”— তখন তার অন্তরে অহংকার জন্ম নেয়। আল্লাহ এমন অহংকারীদের ব্যাপারে কুরআন বলেছেন –
قَالَ اِنَّمَاۤ اُوْتِیْتُهٗ عَلٰى عِلْمٍ عِنْدِیْ١ؕ اَوَ لَمْ یَعْلَمْ اَنَّ اللّٰهَ قَدْ اَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهٖ مِنَ الْقُرُوْنِ مَنْ هُوَ اَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَّ اَكْثَرُ جَمْعًا١ؕ وَ لَا یُسْئَلُ عَنْ ذُنُوْبِهِمُ الْمُجْرِمُوْنَ

এতে সে বললো, “এসব কিছু তো আমি যে জ্ঞান লাভ করেছি তার ভিত্তিতে আমাকে দেয়া হয়েছে।” –সে কি এ কথা জানতো না যে, আল্লাহ‌ এর পূর্বে এমন বহু লোককে ধ্বংস করে দিয়েছেন যারা এর চেয়ে বেশী বাহুবল ও জনবলের অধিকারী ছিল? অপরাধীদেরকে তো তাদের গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় না।  সুরা আল-ক্বাসাস ৭৮

রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন –
إنا لا نُولِّي هذا العملَ أحدًا سألهُ، أو أحدًا حرصَ عليهِ”
আমরা এমন কাউকে নেতৃত্ব দিই না, যে তা চায় বা এর প্রতি আগ্রহ দেখায়।  সহিহ বুখারী, ৭১৪৯ স

নেতৃত্ব ও খ্যাতির প্রতিযোগিতা মুসলিম সমাজ ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে, ঐক্য নষ্ট করে,বরকত কমিয়ে দেয়, আর আল্লাহর সাহায্য দূরে সরে যায়।
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন
من لبس ثوبَ شهرةٍ ألبسهُ اللهُ ثوبَ مذلّةٍ يومَ القيامة
যে খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যে পোশাক পরিধান করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে অপমানের পোশাক পরাবেন।— (সুনান আবু দাউদ, 4029)

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন –
وَ اَطِیْعُوا اللّٰهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ لَا تَنَازَعُوْا فَتَفْشَلُوْا وَ تَذْهَبَ رِیْحُكُمْ وَ اصْبِرُوْا١ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَۚ

আর আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না, তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে যাবে। সবরের পথ অবলম্বন করো, অবশ্যি আল্লাহ‌ সবরকারীদের সাথে রয়েছেন। (আল-আনফাল ৪৬)

যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং মানুষের চোখে ‘খ্যাতিমান’ হতে চায়— তাদের কর্ম আল্লাহর কাছে মূল্যহীন। অতএব ইসলামী আন্দোলনের সকল স্তরের দায়িত্বশীল ও জনশক্তি এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পারলে আন্দোলনের অভ্যান্তরীন পরিবেশ ভালবায় ভরপুর হয়ে থাকবে।

স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সংগঠনে সম্পৃক্ত হওয়া
ইসলামী সংগঠনে মাঝে মাঝে এমন কিছু লোকের আগমন ঘটে, যারা মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থ, পদমর্যাদা, খ্যাতি বা বস্তুগত লাভের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়। তাদের নিজস্ব কোনো দৃঢ় মতামত না থাকলেও, স্বার্থে আঘাত আসবে এমন কোনো বিষয় সামনে এলে তারা মতবিরোধে লিপ্ত হয়।

তবে এমন বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, গোয়েন্দাগিরি বা স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সংগঠনে যোগ দেওয়ার পর প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম ও দায়িত্বশীলদের সোহবতে থেকে অনেক ব্যক্তি আমূল পরিবর্তিত হয়েছেন এবং সত্য স্বীকার করে সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

কিন্তু যারা শুধুমাত্র দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য সংগঠনে যুক্ত হন, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন —
وَ مِنَ النَّاسِ مَنْ یَّقُوْلُ اٰمَنَّا بِاللّٰهِ وَ بِالْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ مَا هُمْ بِمُؤْمِنِیْنَۘ

কিছু লোক এমনও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের দিনের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মু’মিন নয়। (আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ৮)

وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قَالُوْۤا اٰمَنَّا١ۖۚ وَ اِذَا خَلَوْا اِلٰى شَیٰطِیْنِهِمْ١ۙ قَالُوْۤا اِنَّا مَعَكُمْ١ۙ اِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِءُوْنَ

যখন এরা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয়, বলেঃ আমরা ঈমান এনেছি- আবার যখন নিরিবিলিতে নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলেঃ আমরা তো আসলে তোমাদের সাথেই আছি আর ওদের সাথে তো নিছক তামাশা করছি।(আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১৪)

সুরা নিসার ৭২,৭৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাদের পরিচয় দিয়েছেন যেভাবে –
তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা পেছনে পড়ে থাকে। যদি তোমাদের কোনো বিপদ আসে, বলে, ‘আল্লাহ তো আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে আমি তাদের সাথে ছিলাম না।’ কিন্তু যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ আসে, তখন সে বলে, ‘ইশ! আমি যদি তাদের সাথে থাকতাম।

শুধুমাত্র লাভের আশায় যারা ইসলামী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়, তারা ত্যাগ ও কষ্টের সময়ে গা-ঢাকা দেয়।
এ ধরনের ব্যক্তিরা আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে আন্দোলনের সাময়িক ক্ষতি করলেও নিজের স্থায়ী ক্ষতি নিশ্চিত করে।
তাই এমন ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যেক কর্মী ও দায়িত্বশীলদের এ দোয়া করা দরকার
হে আল্লাহ! আমাদের নিয়তকে খাঁটি করো, আমাদেরকে এমন বানাও যারা তোমার সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে, কোনো দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য নয়।

অপরের মত গ্রহণে অনীহা
আন্দোলনের সুন্দর পরিবেশ নষ্ট ও অনৈক্যের অন্যতম কারণ হলো — অপরের মত গ্রহণে অনীহা, অর্থাৎ মতের কুরবানী দিতে না পারা। কোনো বিষয়ে সুন্দর ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও তা বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি হয়, কারণ সিদ্ধান্তটি যদি কারও ব্যক্তিগত মতের সঙ্গে না মেলে, তবে অনেকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেন।

অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে পরামর্শদাতা বয়সে ছোট, সমাজে কম প্রভাবশালী বা শিক্ষাগত যোগ্যতা কম হওয়ার ফলে তাঁর পরামর্শটি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী হলেও, কেবল ব্যক্তিগত অহংকার বা মানসিক সংকীর্ণতার কারণে কিছু মানুষ তা গ্রহণ করতে পারেন না।
এই অনীহা সাংগঠনিক ঐক্যকে দুর্বল করে এবং আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে।

আবেগপ্রবণতা
প্রতিটি মানুষেরই আবেগ থাকে। তবে আবেগের সঙ্গে বাস্তবতার সমন্বয় ঘটলে তবেই কোনো কাজের মান ও হক আদায় করা সম্ভব হয়। কিন্তু শুধুমাত্র আবেগের উপর নির্ভর করলে তা অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আবেগী জনশক্তি যতক্ষণ আবেগের উত্তেজনায় থাকে, ততক্ষণ তারা সকল কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখে— জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করে যায়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিকে মেনে নিতে তাদের অনেকেরই কষ্ট হয়। ফলে আন্দোলনের ভেতরে নিজের ভূমিকা অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে, আন্তরিক ও স্বেচ্ছাসেবী অনেক কর্মীকেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতে দেখা যায়।
সংগঠনের কোনো সিদ্ধান্ত নিজের মতের সঙ্গে না মিললে কেউ কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেয়, নেতৃত্বের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, এমনকি অগ্রাহ্যও করে বসে। এর ফলে নেতৃত্বের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, সংগঠনের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো— অনেকে পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই বাহিরের লোকজনের সামনেও সংগঠনের সমালোচনা করে, যার ফলে সংগঠনের দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
ইসলামী আন্দোলনের আবেগপ্রবণ কর্মীদের তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হয়। অন্যথায় সামান্য মতানৈক্যই শত্রুতায় রূপ নিতে পারে। ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত হওয়া উচিত যুক্তিনির্ভর চিন্তা, পর্যাপ্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে।
আবেগপ্রবণ কর্মীদের সঙ্গে যদি কোনো মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, তবে তা দ্রুত সমাধান করা একজন বুদ্ধিমান ও দায়িত্বশীল নেতার কর্তব্য। কারণ, আবেগকে দমন নয়— বরং সঠিক দিকনির্দেশনায় পরিচালিত করলেই ইসলামী আন্দোলন হয়ে উঠবে শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও সফল।

সবর করতে না পারা
ইসলামী আন্দোলনের মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে নানা বাধা, কষ্ট, নির্যাতন ও পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। সকল অবস্থায় সবর করা, ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অটল থাকা— ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এটি অপরিহার্য গুণ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনে বলেছেন —

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اصْبِرُوْا وَ صَابِرُوْا وَ رَابِطُوْا١۫ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ۠
হে ঈমানদারগণ! সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখাও, হকের খেদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে। (আলে-ইমরান, আয়াত: ২০০)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন-

وَ لَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَیْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَ الْجُوْعِ وَ نَقْصٍ مِّنَ الْاَمْوَالِ وَ الْاَنْفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ١ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیْنَۙ

আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানী হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে — তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও।( সূরা বাকারা: ১৫৫)

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ
হে ঈমানদারগণ! সবর ও নামাযের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ‌ সবরকারীদের সাথে আছেন।
সূরা আল-বাকারা: ১৫৩

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন : জেনে রাখো, সাহায্য আসে ধৈর্যের মাধ্যমে, স্বস্তি আসে কষ্টের পরে, আর প্রতিটি কষ্টের সঙ্গে থাকে স্বস্তি।— (তিরমিযি, হাদীস: ২৫১৬)

অনেক সময় যখন পরীক্ষা শুরু হয়, তখন কিছু কম-সবরওয়ালা জনশক্তি নানা বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু সবরহীন মানুষ ইসলামী আন্দোলনের এই দীর্ঘ ও কঠিন পথে টিকে থাকতে পারে না।

ঐক্যের মিছিলে শামিল হওয়া যায় কিন্তু টিকে থাকতে হলে- ব্যক্তি চরিত্র থেকে লোভ, হিংসা, ক্রোধ, দাম্ভিকতা,খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা, আত্বতৃপ্তি,লৌকিকতা, এবং কৃপনতা পরিহার বাধ্যতা মুলক।

চলবে—-


লেখক: সভাপতি, পর্তুগাল মুসলিম কমিউনিটি ( CRCIPT)