২০২৫ সালের শুরু থেকেই ফ্রান্স-ইতালি সীমান্তে কড়াকড়ি জোরদার করেছে ফরাসি সীমান্ত পুলিশ (পিএএফ)। এর অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ৪০০ অভিবাসীর প্রবেশ ঠেকানো হয়েছে। বিশেষ করে আল্প-মারিতিম অঞ্চলের সীমান্তবর্তী শহর মন্তোতে এসব অভিযানের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে।
তিনি বলেন, ‘গত আট মাসে আটক অভিযান কিছুটা (আট শতাংশ) কমেছে, কিন্তু অভিবাসন প্রবাহ এখনও খুবই বেশি। গড়ে প্রতি সপ্তাহে ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আটক করে আবার ইতালিতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।’
তার দাবি, গত তিন সপ্তাহ ধরে আবারও আটকের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক সময় দৈনিক ৫০ থেকে ৮০ জনকে আটক করা হচ্ছে।
প্রশাসনের ধারণা, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ আটক হওয়া অভিবাসীর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পরিসংখ্যানটি ২০২৪ সালের সঙ্গে প্রায় সমান হলেও ২০২৩ সালের ৪৪ হাজারের তুলনায় অনেক কম। তবে সংখ্যাগুলো পুরোপুরি সঠিক চিত্র তুলে ধরে না, কারণ অনেক অভিবাসীকে একাধিকবার আটক করে ফেরত পাঠানো হয়।
প্রেফেকচুরের তথ্য অনুযায়ী, আটক হওয়া অভিবাসীদের ৪২ শতাংশই সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করেছেন দুই দেশের মধ্যকার আঞ্চলিক ট্রেনে চড়ে, যা ইতালির ভেন্তিমিলিয়া থেকে ফ্রান্সের কোত দাজুর উপকূল ধরে চলাচল করে।
এ বছর আটক হওয়া অভিবাসীদের বেশিরভাগই তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া ও মরক্কো থেকে এসেছেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ হলেন অভিভাবকবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক। কিশোরদের আটক করার পর স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নেওয়া হয়।
কঠোর নজরদারিতে সীমান্ত
দশ বছর আগে প্রথম এই সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। শুরুতে পরিবেশ সম্মেলন (কপ২১) এবং পরে ২০১৫ সালের নভেম্বরে সন্ত্রাসী হামলার পর তা চালু রাখা হয়। এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস পরপর ফ্রান্স এই ব্যবস্থাকে নবায়ন করে আসছে।
শেঙ্গেন প্রবিধান অনুযায়ী, ‘গুরুতর জননিরাপত্তা হুমকি’ থাকলে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়। ২০২৫ সালের ৭ মার্চ ফরাসি প্রশাসনিক আদালত ‘কনসেই দেতা’ রায় দিয়েছে, এসব নিয়ন্ত্রণ শেঙেন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ‘প্রয়োজনীয়’৷ বর্তমানে এ ব্যবস্থা ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল রাখার কথা রয়েছে।
ইতালিতে ফেরত পাঠানো
শেঙ্গেন বিধিমালা অনুসারে, সীমান্তে আটক হওয়া অভিবাসীদের তাদের প্রথম আগমনের দেশ অর্থাৎ ইতালিতে ফেরত পাঠানো যায়। তবে এ প্রক্রিয়া কেবল দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই সম্ভব।
বাস্তবে এর মানে হলো, ফরাসি মাটিতে আটক হওয়া অভিবাসীদের আশ্রয় প্রার্থনার সুযোগ না দিয়েই ইতালিতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানায়, গত শীতকাল থেকে ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়া আবারও বেড়ে গেছে। দাতব্য সংস্থা ‘মেদসাঁ দ্যু মন্দ’–এর ইসাবেল লর ইনফোমাইগ্রেন্টসকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বলেন, ‘অনেকেই আশ্রয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে অথবা সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ অযথোপযুক্ত, কখনও কখনও কোনো দোভাষীও ছিল না।’
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে বলে জানায় সংগঠনগুলো। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ক্রিস্টিন পুপোঁ জানান, আমাদের চাপের ফলে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে অভিভাবকহীন নাবালকদের আর নিয়মিতভাবে ইতালিতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। বরং তাদের বয়স স্বীকৃত হলে সামাজিক সুরক্ষা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।’
দশ বছরে ৪৮ জনের মৃত্যু
সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে অভিবাসীরা এখন অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিচ্ছেন। কেউ রেললাইন ধরে হেঁটে যান, কেউ মহাসড়ক ধরে, আবার কেউ ট্রাকের ভেতরে লুকিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করেন।
সবচেয়ে বিপজ্জনক পথ হলো ভেন্তিমিলিয়া-মন্তো রুট৷ ২০২৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের সপ্তাহান্তে সাতজন অভিবাসীকে সীমান্তের পাহাড়ি একটি দুর্গম পথ থেকে আটক করা হয়, যেটি পার হতে ৭ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে এবং স্থানীয়রা একে ‘মৃত্যুর পথ’ বলে ডাকে। এ সময় একজন অভিবাসী পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন।
কেউ কেউ আবার উত্তর দিকের হউত-আল্পস পর্বতমালা দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে টিউনিশিয়া থেকে আসা দুই চাচাতো ভাই রমজি ও মাহের ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেছিলেন, ‘আমরা ট্রেনে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রথমবারেই মন্তোতে পুলিশ আমাদের ধরে ফেলে। পরে আমরা পাহাড়ি পথ বেছে নিই। চার দিন ধরে খেতে পারিনি, হাঁটতে হাঁটতে শরীর ভেঙে পড়েছে।’
গবেষক ও নাগরিক সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ফ্রান্স-ইতালি সীমান্তে অন্তত ৪৮ জন অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ অভিবাসীর বয়স ছিল ১৬ বছর।
গবেষক ক্রিস্তিনা দেল বিআজিও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘আল্পস অঞ্চলকে কার্যত শত্রুভাবাপন্ন জায়গায় পরিণত করা হয়েছে। মানুষ এখন রাতে পার হওয়ার চেষ্টা করে। এতে তাদের যাত্রা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ১৯৯৩ সালের পর থেকে আল্পসে মারা যাওয়া অভিবাসীদের ৭২ শতাংশের মৃত্যু ঘটেছে ২০১৫ সালের পর।’
সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস