২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ফিলিস্তিনিরা শোক নয় ন্যায়বিচার চায়

ইমান হিলিস

এক বছর আগে আমার প্রিয় বন্ধু ও আত্মীয় সাংবাদিক আমনা হোমাইদ তাঁর ১১ বছর বয়সী বড় সন্তান মাহদিসহ নির্মমভাবে খুন হন। ইসরায়েলি মিডিয়া কর্তৃক তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানির পর তাঁকে নিশানা করা হয়।

আমার এখনও মনে আছে, এতে শোক ও সমবেদনার বন্যা বয়ে গিয়েছিল। এ কারণে তাঁর হত্যার পর প্রথম কয়েক দিন পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত ছিলেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়া আমনার স্বামীর কাছে সমবেদনা জানিয়েছিল। তাঁর হত্যা ও ঘটনার পূর্ববর্তী উস্কানিবিষয়ক নিবন্ধগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। সামাজিক মাধ্যম আমনা ও তাঁর কৃতিত্বের ব্যাপারে উপচে পড়া পোস্ট দেখা গেছে। সব একই শোকের কলতানে বিভোর ছিল।

এদিকে তাঁর শোক পালনকারীদের শোক গর্ব ও দোষারোপের মধ্যে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। কেননা, তাঁকেই দোষারোপ করা হয়েছিল। হত্যাকারী ইসরায়েলের ওপর নয়; হত্যার অনুমতি দেওয়া বিশ্বনেতৃত্বকেও নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের আওতামুক্ত একটি দেশে সাংবাদিকতার বিপজ্জনক পথ বেছে নেওয়া আমনার সিদ্ধান্তে ওপর দোষারোপের অঙ্গুলি নির্দেশিত হলো। অবশেষে এ শোক ম্লান হয়ে পড়ল। এভাবে আমনা ধীরে ধীরে বিস্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে যেতে লাগলেন। আর কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার কখনও তাঁর হত্যার তদন্ত চায়নি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছে তা ব্যতিক্রম নয়। এটিই নিয়মে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে খুন হওয়া সাংবাদিক হুসাম আল-মাসরি, মোহাম্মদ সালামা, মরিয়ম আবু দাক্কা, আহমেদ আবু আজিজ ও মোয়াজ আবু তাহার ক্ষেত্রেও হয়তো এটিই ঘটবে। এই গণহত্যা এখন অল্প সময়ের জন্য সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। তবে আমনার হত্যাকাণ্ড শিগগির ভুলে যাবে। যদিও এই সাংবাদিকরা সুরক্ষিত বেসামরিক নাগরিকের আওতায় ছিলেন এবং তারা এমন একটি চিকিৎসা কেন্দ্রের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যা মানবিক আইনের অধীনে বিশেষভাবে সুরক্ষিত। তবুও তাদের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটল। কেউ ইসরায়েলের দাবি করা ‘ভুল’-এর জন্য তাদের জবাবদিহির মুখোমুখি কিংবা তদন্তও করবে না।

জুন মাসে সাংবাদিক মারওয়া মুসাল্লামকে তাঁর দুই ভাইসহ জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। মার্চ মাসে হুসাম শাবাতকে হত্যা করা হয়। এই ভয়াবহ চক্রটির বারবার পুনরাবৃত্তি দেখার পর ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, একটি রিপোর্টিং ক্যারিয়ার সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারের জন্য মৃত্যুদণ্ডতুল্য।

পরিবারের যারা বর্তমানে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন তাদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে, তারা যেন তাদের কাজের সুর নরম করে আনেন এবং প্রচারের বাইরে থাকেন। আমার চাচা ও আমনার শ্বশুর হামেদ আমাকে বলেছিলেন, তিনি তাঁর অন্য ছয় সন্তানের কাউকেই সাংবাদিকতার সঙ্গে দূরবর্তী সম্পর্কের পেশায়ও যুক্ত হতে দেবেন না– ‘অভিনয় করবেন না, সাংবাদিকতা করবেন না। আমি তাদের কখনোই মিডিয়ার সামনে আসতে অনুমতি দেব না।’

তিনি এ সময় আরও বলেন, ‘আমি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য যে কাউকে উৎসাহিত করতাম। আমি বলতাম, এটা সত্যের পাটাতন। আমনার পর আমি এ সম্পর্কিত সবকিছু ঘৃণা করতাম।’ এমনকি আমনার স্বামী সাঈদ হাসৌনা, যিনি নিজেও একজন সাংবাদিক এবং এ ক্ষেত্রে আগ্রহী তরুণদের পরামর্শ দিতেন। তিনিও আমনার হত্যার পর ধীরে ধীরে তাঁর কাজ কমিয়ে দেন।

এখন পর্যন্ত গাজ্জায় ২৪৪ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক খুন হয়েছেন। তাদের সবার সঙ্গে একই আচরণ করা হয়েছে। এমনকি বিস্তারিতভাবে নথিভুক্ত হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়নি। ২০২২ সালে জেনিনে একজন ইসরায়েলি স্নাইপারের হাতে নিহত শিরিন আবু আকলেহের ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য একটি পূর্বাভাস ছিল। এমনকি তাঁর মার্কিন নাগরিকত্ব ও তাদের মিডিয়া তদন্ত করেও ন্যায়বিচার পায়নি।

যদি ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের জন্য শোক জানালে আপনার অপরাধবোধ কম হয়; যদি মনে হয় আপনি তাদের প্রতি আপনার কর্তব্য পালন করেছেন, তাহলে তাদের জন্য শোক করবেন না। আমাদের আর প্রশংসার প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার ন্যায়বিচার। মরিয়ম, আমনা, আনাস এবং গাজ্জার বাকি ২৪৪ জন খুন হওয়া সাংবাদিকের এতিম শিশুদের জন্য বিশ্ব যা করতে পারে, তার সবচেয়ে ন্যূনতম হলো এসব হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

লেখক : সাংবাদিক ও গাজ্জাভিত্তিক ফ্যাক্টচেকার