২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

প্যারিসের সমাধিক্ষেত্রে বইপড়ুয়াদের আড্ডা

মুমিত আল রশিদ

গোরস্তানে বইপড়ুয়াদের আড্ডা! ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে বসে প্রিয় লেখকের বই পড়া, ভাবা যায়? ইরানে, রাজধানী তেহরানের অদূরে বেহেশতি জাহরা ও রেই শহরের শাহ আবদুল আজিম সমাধিক্ষেত্র। সিরিয়ায় ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী অজপাড়াগাঁয়ের শান্ত-স্নিগ্ধ সমাধিক্ষেত্র। এমনকি দামেস্কের অদূরে সাহনায়ায় দেখেছি দ্রুজ সম্প্রদায়ের সমাধিক্ষেত্র। চীনে সাংহাইয়ের বৌদ্ধ সমাধিক্ষেত্র আর থাইল্যান্ডের নাখন পাথম প্রদেশে একটি বৃহৎ সমাধিক্ষেত্র দেখার সুযোগও হয়েছিল। কিন্তু ফ্রান্সের প্যারিসে পিয়ার ল্যাচেইশ (Pere Lachaise) সমাধিক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা কোনোটির সঙ্গেই মেলে না। অনেকে পের ল্যাচেশ, কেউ কেউ পার লাশেসও বলেন। প্যারিসের আরেকটি বিখ্যাত সমাধিক্ষেত্র লে পন্তে বা ল্যা প্যানথন (Le Pantheon)।

বেশির ভাগ পর্যটকের কাছে ফ্রান্স মানেই প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর মিউজিয়াম, নটর ডেম ক্যাথেড্রাল, নেপোলিয়নের বিজয়োল্লাস তোরণ আর্ক ডে ট্র্যেম্ফে, বাস্তিল দুর্গ, সেন নদীর তীর আর গ্র্যান্ড মসজিদ। প্যারিসের অদূরে ভার্সাই শহর, এ ছাড়া চলচ্চিত্রের শহর কান তো আছেই। ফরাসিদের প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো পর্যটকদের বরাবরই আকৃষ্ট করে। প্যারিস যেন সহস্র ঝলমলে কৃত্রিম আলোর চোখধাঁধানো ঝলকানির আড়ালে হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এক জলকুমারী। সৌন্দর্যবোধ, ইতিহাস–চেতনা, শিল্প ও সাহিত্য, রোমান্টিসিজম আর জীবনদর্শনের ছড়াছড়ি যেন প্যারিসের প্রতিটি গলিঘুচিজুড়ে। প্রাণবন্ত আড্ডায় কফির উষ্ণতা, শ্যাম্পেনের বুদ্‌বুদ আর বিশ্বখ্যাত সব নামীদামি ফরাসি পারফিউমের সৌরভ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চারপাশে।

ইউনেসকোর জরিপে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় জাদুঘরগুলোর একটি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পর্যটক মুখরিত সমাধিক্ষেত্রের অবস্থানও কিন্তু প্যারিসেই। এখানে আছেন অনেকেই। জনপ্রিয় আইরিশ লেখক, কবি, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, ইংরেজি সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী অস্কার ওয়াইল্ড, আমেরিকান সংগীতশিল্পী, গীতিকার, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক, ক্রেজি ব্যান্ড তারকা, কবি ও রক ব্যান্ড দ্য ডোরস প্রধান জিম মরিসন, ‘ছোট্ট চড়ুইপাখি’ নামে খ্যাত প্রসিদ্ধ ফরাসি গায়ক এডিথ পিয়াফ, পোলিশ সংগীত কম্পোজার ও পিয়ানিস্ট ফ্রেডরিখ চপিন, ইতালির বিখ্যাত অপেরা কম্পোজার ও বিখ্যাত অপেরা ‘দ্য বারবার অব সেভিলে’-এর জনপ্রিয় কম্পোজার জিওয়াচিনো রশিনি, সেলিব্রেটি ফরাসি অভিনেত্রী সারাহ ব্রেখত, বিখ্যাত ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের, ফরাসি সাহিত্যের দৈত্য বলে খ্যাত হোনরে দ্য বালজাক। মধ্যযুগের ট্র্যাজিক রোমান্টিক হিরো-হিরোইন অ্যাবেলার্দ ও হ্যালোইজে; বলা হয়ে থাকে অ্যাবেলার্দ ও হ্যালোইজের সমাধি হচ্ছে এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন সমাধি। আরও আছেন আধুনিক প্যারিসের অন্যতম গোড়াপত্তনকারী আর্কিটেক্ট ব্যারন হ্যাসম্যান, আমেরিকার আধুনিক নৃত্যের অগ্রদূত ইসাডোরা ডানকান, ইরানের ফারসি কথাসাহিত্যে আধুনিকতাবাদী কৌশলের প্রবর্তক, ফারসি সাহিত্যে সুররিয়ালিজমের প্রবক্তা, অনুবাদক ও ব্যঙ্গাত্মকধর্মী লেখক সাদেক হেদায়েত।

ইরানি চলচ্চিত্রের দার্শনিক গল্পকার এবং যাঁর গল্পে নির্মিত চলচ্চিত্রের কারণেই ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরও ইরানি চলচ্চিত্র বেঁচে আছে, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির চলচ্চিত্র গাভ (The Cow, ১৯৬৯ খ্রি.)-এর চিত্রনাট্যকার, বহুল প্রশংসিত অসংখ্য গল্প, উপন্যাসসহ ৪০টির বেশি গ্রন্থপ্রণেতা গোলাম হোসেইন সায়েদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বরেণ্য পেশার ব্যক্তিরা শুয়ে আছেন পিয়ার ল্যাচেইশ বা পের ল্যাচেশ (Père Lachaise) সমাধিক্ষেত্রে।

মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখসহ নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাধি রয়েছে এখানে। বহুমাত্রিক বর্ণ আর গোত্রের বৈচিত্র্যময় রং নিয়ে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে তাই সমাধিক্ষেত্রটি সারা বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন পর্যটকের আগমনে মুখরিত হয়।

বিশ্বব্যাপী ভ্রমণকারীদের অধিকাংশেরই ঐতিহাসিক স্থাপনা, জাদুঘর, পাহাড়, মরুভূমি, সমুদ্রসৈকতের ব্যাপারে প্রধান আগ্রহ থাকে। তবে আমার ক্ষেত্রে ভ্রমণের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে স্থানিক ও সর্বজাতীয় শিক্ষা, সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি বিকাশের মূল কারিগর দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের সমাধিস্থল দর্শন। এটি আমাকে একধরনের আত্মিক শান্তি দেয়। একে মহান আত্মার অধিকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে একধরনের আত্মিক যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টাও বলা যেতে পারে।

পিয়ার ল্যাচেইশ সমাধিক্ষেত্রটির আয়তন ৪৩ দশমিক ২০ হেক্টর বা ১১০ একর। ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে অ্যালেকজান্ডার থিওডোর ব্রোংনারটের ডিজাইনে নেপোলিয়ন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্যারিশ সিমেট্রিস থেকে বর্তমান সমাধিক্ষেত্রে স্থানান্তর করেন। অতীতে এটি ‘পূর্বের সমাধিক্ষেত্র’ (Cemetery of the East) হিসেবে পরিচিত ছিল। প্যারিসের যেকোনো স্থান থেকে সহজে যাতায়াতের জন্য এখানে একটি মেট্রো স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। প্যারিস মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ মেট্রো লাইন-২ দ্বারা ফিলিপ্পে অগাস্টে (Philippe Auguste) স্টেশন থেকে পিয়ার ল্যাচেইশ স্টেশন পর্যন্ত টেনে এনেছেন, অন্যদিকে মেট্রো লাইন-৩ থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে অবস্থিত ফ্রান্সের সর্ববৃহৎ এই পিয়ার ল্যাচেইশ সমাধিক্ষেত্র। এখানে প্রায় সত্তর হাজারের মতো সমাধি বিদ্যমান। টিলাসম উচ্চতার পিয়ার ল্যাচেইশ সমাধিক্ষেত্র প্যারিসের সবচেয়ে বেশি সবুজ অরণ্যের অধিকারী পার্ক। বিশাল সব বৃক্ষরাজি, ছোট ছোট বসার বেঞ্চ এটির সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। প্রিয় ব্যক্তির সমাধিস্থল সহজে চেনার স্বার্থে কর্তৃপক্ষ প্রবেশপথে একটি রঙিন নির্দেশিকা হাতে ধরিয়ে দেবে, যেখানে ব্যক্তির নাম, সমাধি নম্বর, রোড নম্বর দেওয়া থাকে। গুগল ম্যাপ এখানে দারুণ সক্রিয়। সোজা প্রিয় ব্যক্তির সমাধির কাছে নিয়ে যাবে। তবে সঠিক অবস্থান চিনতে সমস্যা হলে আশপাশে প্রচুর দর্শনার্থী পাবেন; কেননা এখানে গ্রিক সমাধিক্ষেত্র নেক্রোপোলিস (necropolis)-এর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে।

১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুরাগী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ফরাসি নাট্যকার ও পশ্চিমা সাহিত্যের সেরা হাস্য-রসাত্মক লেখকদের একজন হিসেবে বিবেচিত মলিয়ের (Moliere, ১৫ জানুয়ারি, ১৬২২ খ্রি.–১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬৭৩ খ্রি.) ও ফরাসি উপকথার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ও কবি জিন দ্য লা ফন্টেইন (Jean de La Fontaine, ৮ জুলাই, ১৬২১ খ্রি.-১৩ এপ্রিল, ১৬৯৫ খ্রি.)–এর সমাধি পিয়ার ল্যাচেইশে নিয়ে আসা হয়।

গত ১০ জুন মঙ্গলবার প্যারিসে পৌঁছে দুপুরে অল্পবিস্তর বিশ্রাম নিয়ে মূলত ইরানি লেখক সাদেক হেদায়েতের সমাধি দেখার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। কিন্তু রাত ৮টা বেজে যাওয়ায় নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছিল। যদিও প্যারিসে সন্ধ্যা মামা বেশ বিলম্বেই আগমন করেন। জুন মাসে স্থানীয় সময় রাত ১০টায় সূর্য অস্তমিত হয়। তবে ১৩ জুন শুক্রবার বেশ আটঘাট বেঁধে দুপুরের খাবার খেয়ে গিয়েছিলাম। তখনো জানতাম না এখানে শুয়ে আছেন অস্কার ওয়াইল্ড, জিম মরিসন, মলিয়েররা। আইরিশ রোমান্টিক কবি অস্কার ওয়াইল্ডের কবরের বড় পাথর দেখে বিস্ময়ে আবেগাপ্লুত হয়েছি। সেখানকার চারপাশের দেয়াল চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছেন অতি আবেগপ্রবণ ভক্তরা। ফলে কবরস্থান কর্তৃপক্ষ চারপাশে কাচের দেয়াল তুলে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও থেমে নেই ভক্তদের উন্মাদনা; বিশ্বখ্যাত নামীদামি ব্র্যান্ডের লিপস্টিকগুলোও কাচের দেয়ালঘেরা কবরের মধ্যে জমা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

জিম মরিসনের কবরেও একই অবস্থা! ভক্তরা রেখে গেছেন বিশ্বের নামীদামি ব্র্যান্ডের সিগারেট, গিটার, টি-শার্ট। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি সমাধিক্ষেত্রের পাশের বেঞ্চে বসে অনেকেই প্রিয় লেখকের বই পড়ছেন। ওমর খৈয়ামের ভাষ্যে—‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা—যদি তেমন বই হয়।’ এ জাতির বই পড়ার নেশার দিকে তাকিয়ে শুধু এ রুবাইটি বারবার মনে পড়ছিল।

এখানকার সমাধিগুলোর অধিকাংশে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য চোখে পড়ল! কবি-সাহিত্যিকদের সমাধিগুলোর অধিকাংশে বইয়ের ভাস্কর্য দৃশ্যমান। একজন বললেন, যেখানে সাহিত্যের লোকেরা ঘুমায়, সেখানে সাহিত্য সুবাস ছড়ায়। কথাটির প্রমাণ আমি পেয়েছিলাম ইরানি কবি হাফিজ শিরাজির মাজারে। সেখানে অধিকাংশ হাফিজপ্রেমী সমাধির তীরে বসে হাফিজের গজল আবৃত্তি করেন ও চোখের অশ্রু ফেলেন। প্যারিসের পিয়ার ল্যাচেইশের সমাধিক্ষেত্রে এসে মনে হলো বিশ্বসাহিত্য আগলে রাখার একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতির মুখোমুখি হলাম।