আবদুল আহাদ সালমান
ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের সঙ্গমে অবস্থিত এক মনোরম দেশ পর্তুগাল। আজ এটি আধুনিক, পর্যটননির্ভর ও উন্নত ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও, এই ভূমির অতীত ইতিহাসে রয়েছে ইসলামী সভ্যতার এক দীপ্ত অধ্যায়।
প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসন ও সংস্কৃতি এই দেশকে প্রভাবিত করেছে। শিক্ষা, স্থাপত্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও দর্শনে মুসলিম অবদানের গভীর ছাপ আজও পর্তুগালের সমাজে দৃশ্যমান।
ইতিহাসের সূচনা : আল-আন্দালুসের অন্তর্গত পর্তুগাল :
৭১১ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার মাঘরেব অঞ্চল থেকে আগত মুসলিম সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইর ইবেরীয় উপদ্বীপে ইসলামী বিজয়ের সূচনা করেন। তাদের এই অভিযানের ফলেই আজকের স্পেন ও পর্তুগাল “আল-আন্দালুস” নামে ইসলামী সভ্যতার অংশে পরিণত হয়।
মুসা বিন নুসাইরের পুত্র আবদুল আজিজ বিন মুসা এই অঞ্চলের প্রশাসনিক ও সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলেন। তার আমলে শিক্ষা, কৃষি ও বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। শহরগুলোতে গড়ে ওঠে বিদ্যালয়, বাজার, বাগান ও উন্নত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। মুসলিম স্থপতিরা শহরের পরিকল্পনায় এমন দক্ষতা দেখান, যা আজও ইউরোপীয় নগরায়নের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
মুসলিম শাসনের পতন ও রিকনকুয়েস্তা আন্দোলন :
একসময় ইউরোপজুড়ে খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর “রিকনকুয়েস্তা আন্দোলন” (Reconquista) শুরু হয় মুসলিম শাসন পুনর্দখলের লক্ষ্যে। ১১৪৭ সালে লিসবন খ্রিস্টান বাহিনীর হাতে আসে, এবং ১২৪৯ সালে দক্ষিণাঞ্চলীয় অ্যালগার্ভ (Algarve) অঞ্চল দখলের মধ্য দিয়ে পর্তুগালে মুসলিম শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে।
তবে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক প্রভাব পুরোপুরি মুছে যায়নি। মুসলিম স্থাপত্য, কৃষি কৌশল ও ভাষাগত ঐতিহ্য জনজীবনের গভীরে থেকে যায়।
১৪৯৬ সালে রাজা মানুয়েল প্রথম একটি রাজকীয় আদেশে ইহুদি ও মুসলমানদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ বা দেশত্যাগের নির্দেশ দেন। অনেক মুসলমান ধর্মান্তরিত হয়ে ‘মোরিসকো’ নামে পরিচিত হন, আবার অনেকে আফ্রিকা ও আরব অঞ্চলে ফিরে যান। তবুও, ইসলামী ঐতিহ্য পর্তুগালের ইতিহাসে অমোচনীয় হয়ে রয়ে গেছে।
নীরবতা ভেঙে মুসলিমদের প্রত্যাবর্তন :
দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী পর, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলিম অভিবাসীরা পর্তুগালে বসবাস শুরু করেন। তাদের বেশিরভাগই আসে মরক্কো, বাংলাদেশ, গিনি-বিসাউ, পাকিস্তান ও মোজাম্বিক থেকে।
১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় Islamic Community of Lisbon, যা আধুনিক পর্তুগালে মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের সূচনা করে।
১৯৭৭ সালে শুরু হয় লিসবন সেন্ট্রাল মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নির্মাণের কাজ যা ১৯৮৫ সালে সম্পন্ন হয়। এটি মুসলিম শাসনের অবসানের ৫৫০ বছর পর নির্মিত পর্তুগালের প্রথম সরকারি স্বীকৃত মসজিদ।
পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম ইসলামিয়া, দেশের প্রথম ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে আজ শতাধিক শিক্ষার্থী ধর্মীয় ও আরবি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করছে।
বর্তমান মুসলিম সমাজ ও তাদের ভূমিকা :
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালে পর্তুগালে মুসলমানের সংখ্যা ৭০ হাজারেরও বেশি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.৬ শতাংশ। তাদের অধিকাংশই শহুরে অঞ্চলে, বিশেষ করে লিসবন, পোর্তো ও সেটুবাল-এ বসবাস করছে।
দেশজুড়ে রয়েছে প্রায় ২৫টি মসজিদ ও বেশ কয়েকটি ইসলামিক সেন্টার। মুসলিম সম্প্রদায় সামাজিক সেবা, আন্তধর্মীয় সংলাপ ও সংস্কৃতি বিনিময়ের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
তবে ধর্মীয় পোশাক ও অভিবাসন নীতি নিয়ে কিছু বিতর্কও আছে। ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে পর্তুগালের সংসদে মুখ ঢাকা পোশাক (নিকাব বা বোরকা) নিষিদ্ধের প্রস্তাব আলোচনা হয়, যা ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।
মুসলিম ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক ছাপ :
মুসলিম শাসনের দীর্ঘ পাঁচ শতকের ইতিহাস আজও পর্তুগালের সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে আছে।
১। ভাষায় প্রভাব:
পর্তুগিজ ভাষায় প্রায় ৮০০টি শব্দের উৎস আরবি ভাষা। যেমন; Azeite (জলপাই তেল) – আরবি “আয-জায়তুন”, Açúcar (চিনি) – আরবি “আস-সুকর”, Arroz (চাল), algodão (সুতির কাপড়), alface (লেটুস) – সবই আরবি শব্দমূল থেকে এসেছে।
২। স্থাপত্যে প্রভাব:
দক্ষিণ পর্তুগালের অ্যালগার্ভ, মার্তোলা, সিলভেস প্রভৃতি অঞ্চলে মুসলিম দুর্গ, প্রাচীর, মসজিদ-রূপান্তরিত গির্জা, এবং উন্নত পানি সরবরাহ ব্যবস্থার নিদর্শন এখনো সংরক্ষিত আছে।
৩। বিজ্ঞান ও জ্ঞানচর্চা:
ইসলামী শাসনকালে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও নৌবিজ্ঞানে বিশাল অগ্রগতি ঘটে। মুসলিম পণ্ডিতদের তৈরি মানচিত্র ও নৌচালনা জ্ঞানই পর্তুগালের “Age of Discovery”বিশ্বজয়ের যুগের ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
৪। সহাবস্থান ও সহিষ্ণুতা:
আল-আন্দালুস যুগে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ছিল। সেই সামাজিক সহনশীলতা ও জ্ঞানের চেতনা আজও ইউরোপীয় মানবাধিকারের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।
একটি সভ্যতার উত্তরাধিকার :
২০১৮ সালে পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট মার্সেলো রেবেলো দে সোসা এক অনুষ্ঠানে বলেন, “পর্তুগালের আত্মার সঙ্গে ইসলাম মিশে আছে। হয়তো আমরা সচেতনভাবে জানি না, কিন্তু আরবদের অবদান আমাদের সংস্কৃতি, সমাজ ও ভাষায় গভীরভাবে প্রোথিত।”
তার এই মন্তব্যই প্রমাণ করে যে, ইসলামী শাসনের প্রভাব কেবল ইতিহাসের অংশ নয়, বরং আজকের পর্তুগিজ সমাজের অন্তর্গত সত্তা।
মুসলিম শাসন পর্তুগালকে দিয়েছিল বিজ্ঞান, স্থাপত্য, কৃষি, ভাষা ও মানবিক মূল্যবোধের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য।
যদিও ইতিহাসের চাকা ঘুরে মুসলিম শাসনের অবসান হয়েছে বহু আগে, তবুও তার বীজ আজও আধুনিক পর্তুগালের সংস্কৃতি ও চেতনায় অঙ্কুরিত।
আজ যখন লিসবনের মসজিদে আজান ধ্বনি শোনা যায়, তখন মনে হয় অতীত শুধু স্মৃতি নয়, বরং সেটিই ভবিষ্যতের প্রেরণা, সহিষ্ণুতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক।
তথ্যসূত্র : আলজাজিরা, রইটার্স, উইকিপিডিয়া, Portugal.com, CIA World Factbook, The National News