আবদুল আহাদ সালমান
লিসবনের সরু গলি, নীল টাইলের দেয়াল আর পাহাড়চূড়ার দুর্গ আজও নীরবে বলে যায় মুসলিম শাসনের গল্প। ইউরোপের পশ্চিম প্রান্তের এই শহর একসময় ছিল ইসলামি সভ্যতার উজ্জ্বল কেন্দ্র। রাজধানী লিসবনের সবচেয়ে পুরনো অঞ্চল আলফামা (Alfama) আজো বহন করছে সেই ইতিহাসের গন্ধ, সেই সংস্কৃতির পদচিহ্ন।
মুসলিম শাসনের সূচনা: “আল-উশবুনা” থেকে “লিসবন”
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে উত্তর আফ্রিকার মুসলিমরা যখন আইবেরিয়ান উপদ্বীপে প্রবেশ করে, তখন তারা বর্তমান লিসবনসহ পর্তুগালের বৃহৎ অংশ দখল করে।
তারা এই শহরের নাম রাখে আল-উশবুনা (Al-Ushbuna) যা থেকেই বর্তমান “Lisboa” নামের উৎপত্তি।
৭১১ থেকে ১১৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় চার শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসনে লিসবন ছিল বাণিজ্য, শিক্ষা ও স্থাপত্যের অন্যতম কেন্দ্র। এই সময়ে শহরের রাস্তাঘাট, প্রাচীর, কৃষি ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি ইসলামি আদর্শে গড়ে ওঠে।
“আলফামা” নামের উৎস ও ঐতিহাসিক অর্থ :
আলফামা নামটি এসেছে আরবি শব্দ “আল-হাম্মা (Al-Hamma)” থেকে, যার অর্থ গরম পানির ঝরনা বা উষ্ণ প্রস্রবণ।
মুসলিম যুগে এই এলাকায় প্রাকৃতিক উষ্ণ পানির উৎস ছিল, যেখানে নির্মিত হয়েছিল প্রাচীন হাম্মাম (বাথহাউস)। সময়ের সঙ্গে পানির উৎস শুকিয়ে গেলেও নামটি এখনো টিকে আছে, যেন ইতিহাসের এক ছায়া।
দুর্গ ও স্থাপত্যে মুসলিম প্রভাব :
Castelo de São Jorge (সাঁও জর্জ দুর্গ)
আলফামার উপরে অবস্থিত এই দুর্গ ছিল মুসলিম শাসকদের প্রধান প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। এখান থেকেই টাগুস নদী ও পুরো শহর দেখা যেত। দুর্গের দেয়াল ও প্রাচীরের গঠন আজও মুরিশ (Moorish) স্থাপত্যের ছাপ বহন করে।
“দুর্গের প্রতিটি পাথর আজও বলে একদিন এখানেই মুসলিম শাসনের পতাকা উড়েছিল।”
Lisbon Cathedral (Sé de Lisboa)
১১৪৭ সালে খ্রিস্টানরা লিসবন দখল করার পর, পুরনো জামে মসজিদের জায়গায় নির্মাণ করা হয় এই ক্যাথেড্রাল। গবেষকরা বলেন, এর নিচে এখনো মুসলিম যুগের পাথরের ভিত্তি টিকে আছে।
Palácio Belmonte
এই প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছে মুসলিম আমলের দেয়াল ও প্রাচীন গৃহভিত্তির উপর। এর বেসমেন্টে পাওয়া গেছে জ্যামিতিক আরবি অলংকরণ, যা ইসলামিক স্থাপত্যরীতির অনন্য নিদর্শন।
মুসলিম নগর পরিকল্পনা: সরু গলি ও সুরক্ষিত সমাজ
আলফামার গলিগুলোর বাঁক, ঘরগুলোর গঠন, জানালার অবস্থান সবকিছুই মুসলিম শহর পরিকল্পনার প্রতিফলন। এই ধরণের স্থাপত্যে প্রাধান্য দেওয়া হতো গোপনীয়তা, পারিবারিক ঐক্য ও প্রাকৃতিক শীতলতার ওপর। গরম আবহাওয়ায় বাতাস চলাচলের জন্য ঘরগুলো কাছাকাছি ও ছায়াঘেরা রাখা হতো।
এই এলাকা তখনকার মুসলিম সমাজের প্রতিচ্ছবি:
ছোট মসজিদ, বাজার (souq), মাদরাসা, হাম্মাম ও কারিগরদের কর্মশালা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এক প্রাণবন্ত শহরজীবন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন :
আলফামা ছিল ধর্মীয় চর্চা ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। শুক্রবারে জামে মসজিদে নামাজ হতো, মাদরাসায় শেখানো হতো কোরআন, গণিত, চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিদ্যা।
আরবি ভাষা, সংগীত ও শিল্পকলা স্থানীয় সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
আজও পর্তুগিজ ভাষায় অনেক শব্দের উৎস আরবি —যেমন:
“azeite” (তেল), “alfazema” (ল্যাভেন্ডার), “almofada” (বালিশ) ইত্যাদি।
পতনের পরও টিকে থাকা উত্তরাধিকার :
খ্রিস্টীয় ১১৪৭ সালে ক্রুসেডার রাজা আফনসো হেনরিকেস লিসবন দখল করেন। মুসলিমদের অনেকেই তখন শহর ত্যাগ করেন, কিন্তু যারা থেকে যান, তারা “মুদেজার” নামে পরিচিত হয়। তাদের হস্তশিল্প, কারুশিল্প ও স্থাপত্যরীতি আজও লিসবনের ঐতিহ্যের অংশ।
আলফামা ও মুসলিম উপস্থিতি আজ :
আজকের আলফামা পরিণত হয়েছে এক সাংস্কৃতিক রত্নভাণ্ডারে। প্রাচীন ইসলামিক স্থাপত্য ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে এটি লিসবনের সবচেয়ে ঐতিহাসিক পর্যটন এলাকা।
পাশের মোরারিয়া (Mouraria) এলাকায় এখনো মুসলিম অভিবাসীরা বসবাস করেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মরক্কো, ও গিনি থেকে আগত বহু মানুষ সেখানে কাজ ও প্রার্থনা করেন। ছোট ছোট মসজিদ ও ইসলামিক কেন্দ্র এই ইতিহাসের আধুনিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে।
আলফামা শুধু একটি পুরনো এলাকা নয় এটি ইউরোপে মুসলিম সভ্যতার জীবন্ত ইতিহাস। যেখানে আজ গান বাজে, পর্যটক হাঁটে, সেখানেই একদিন আজান ধ্বনিত হতো, মসজিদে পাঠ হতো কোরআনের আয়াত।
“আলফামা আজ ইউরোপের প্রাচীনতম মুসলিম নগরীর শেষ নিঃশ্বাস এক সময় যেখানে ছিল প্রার্থনার নীরবতা, আজ সেখানে প্রতিধ্বনিত হয় ইতিহাসের কণ্ঠস্বর।