স্পেনের অর্থনীতিতে গতি এসেছে। পর্যটন, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অভিবাসনের কল্যাণে দেশটি ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশটি এখনো ইউরো অঞ্চলের শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০২৫ সালে স্পেনের বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস ২ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির প্রবৃদ্ধি হতে পারে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৬, শূন্য ও শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে স্পেনের প্রত্যাশাতীত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, যদিও রয়টার্সের পূর্বাভাস ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। এটি আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায়ও বেশি, ওই ত্রৈমাসিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। স্পেনের জাতীয় পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউট (আইএনই) এই তথ্য জানিয়েছে।
স্পেনের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী কথা বলেছেন দেশটির অর্থমন্ত্রী কার্লোস কুয়ের্পো। এপ্রিল মাসে সিএনবিসিকে তিনি বলেন, দুই বছরের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে স্পেন অগ্রণী হবে। স্পেন এখন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দেশ এবং বিনিয়োগের জন্যও চমৎকার স্থান। স্পেনের অর্থনীতির সাফল্য নির্ভর করছে উচ্চ ভোক্তা ব্যয়, বিনিয়োগ, পর্যটন, নেক্সট জেনারেশন ইউরোপিয়ান ফান্ড ও অভিবাসনের ওপর। কুয়ের্পো বলেন, কেবল পর্যটন নয়, অ–পর্যটন পরিষেবার ক্ষেত্রেও রপ্তানি বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, আর্থিক ও নিরীক্ষা পরিষেবার ক্ষেত্রে রপ্তানি আয় পর্যটনের চেয়ে বেশি—১০ হাজার কোটি ইউরো বনাম ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি ইউরো। এটি স্পেনের অর্থনীতির আধুনিকায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
দৃঢ় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও স্পেনকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, বেতন ও জীবনযাত্রার খরচে সামঞ্জস্য আনা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, রাজনৈতিক বিভাজন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে তরুণদের সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান। বিবিভিএ রিসার্চের প্রধান অর্থনীতিবিদ মিগুয়েল কার্ডোসো বলেন, ২০২১ থেকে শ্রমশক্তির যে বৃদ্ধি, তার ৯০ শতাংশ এসেছে অভিবাসন থেকে। এটি পরিষেবা খাত সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে; সেই সঙ্গে শ্রমের খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করছে। ফলে পরিষেবার দামও উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিবেশে তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত।
স্পেনের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। মহামারির অবসান ও পর্যটন খরচ পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় কম হওয়ার কারণে দেশটি লাভবান হয়েছে। তবে পর্যটকের ঢল নিয়ে স্থানীয় মানুষরা মাঝেমধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখান। ২০২৩ সালের জুনে বার্সেলোনায় প্রতিবাদকারীরা পর্যটকদের গায়ে পানি ছিটিয়ে স্লোগান দেন, পর্যটকেরা বাড়ি ফিরে যাক। ২০২৪ সালে পর্যটন খাতে খাজ করেছেন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ, ২০২৩ সালের তুলনায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে এ খাতে। কাজের সৃষ্টিও অভিবাসনের ওপর নির্ভরশীল। যেখানে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ সীমান্ত বন্ধ করছে, সেখানে স্পেন আগামী তিন বছরে প্রায় ১০ লাখ অভিবাসী গ্রহণের পরিকল্পনা করছে। কার্ডোসো বলেন, গত বছর স্পেনে অভিবাসীদের বেশির ভাগ এসেছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা ও মরক্কো থেকে। লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ ভালো করছে না। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন কঠিন হওয়ায় মানুষ বিকল্প খুঁজছে।
স্পেনের অর্থনীতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেক্সট জেনারেশন ইইউ তহবিল থেকেও সহায়তা পাচ্ছে। স্পেন এই তহবিল থেকে ১৬৩ বিলিয়ন বা ১৬ হাজার ৩০০ কোটি ইউরো পেয়েছে, অনুদান ও ঋণের মাধ্যমে এই অর্থ বিতরণ হচ্ছে। কুয়ের্পো জানান, ৭০ শতাংশ অনুদান ইতিমধ্যেই বিতরণ হয়েছে। কার্ডোসো বলেন, সরকার আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনিয়োগ প্রকল্পে অগ্রাধিকার দিয়েছে, ফলে অর্থনীতিতে গুণগত প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম। তা সত্ত্বেও স্পেন সরকার এই তহবিলকে পর্যটনবহির্ভূত খাত, যেমন নবায়নযোগ্য শক্তি রপ্তানিতে ব্যবহার করার লক্ষ্য হাতে নিয়েছে।
পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে বিনিয়োগের কারণে বিদ্যুতের খরচ কমেছে। ২০০০-এর দশকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে বিনিয়োগের ফলে ২০২২ সালের রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর ইউরোপে যে জ্বালানি সংকট হয়, স্পেনে তার প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। কুয়ের্পো বলেন, পাঁচ-ছয় বছরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৪০ শতাংশ কমেছে। এদিকে উৎপাদন খরচ কম হওয়ার কারণে স্পেন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। চীনের আরটেক কোম্পানি ২০২৪ সালে মাদ্রিদে ইউরোপীয় সদর দপ্তর খুলেছে। তারা সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। স্পেনের বৃহৎ অটোমোবাইল কোম্পানি স্টেলানটিস ও ব্যাটারি কোম্পানি সিএটিএল জারাগোজায় ৪৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে লিথিয়াম আয়ন ফসফেট ব্যাটারি কারখানা তৈরি করবে।
এছাড়া স্পেনে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহ শক্তিশালী। এফডিআই প্রাপ্তিতে স্পেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চতুর্থ আকর্ষণীয় দেশ। ২০২৫ সালে চীন এককভাবে স্পেনে ১১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১০০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করবে। কুয়ের্পো বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্র, তবে চীনের মতো দেশও নবায়নযোগ্য শক্তি ও টেকসই খাতে বিনিয়োগ করছে। এটি আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অংশ।’ পর্যটন, বিনিয়োগ, অভিবাসন ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি মিলিয়ে স্পেনের অর্থনীতি ইউরোপে শক্তিশালী ও ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে উঠছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।